
বিশ্বপ্রিয় মৃধা: দুই বিশিষ্ট সমালোচকের দুটি বক্তব্যের সরলীকরণ– কবিকে তাঁর জীবন-চরিতে পাওয়া যায় না এবং কবির কবিত্বের চেয়ে কবিকে জানার লাভ অনেক বেশি। এই দুটি মত হয়তো ভিন্ন, কিন্তু আলোচনার ক্ষেত্রে দুটি পরস্পরের পরিপূরক মতবাদ। আর কেবল কবি নয়, সমগ্র সাহিত্য তথা সাহিত্যিকের নিরিখে এ মত সমানভাবে গ্রহণযোগ্য। সমালোচকদ্বয় এই সার্বিক অর্থেই যে তা প্রয়োগ করেছেন তা বলার বিশেষ অপেক্ষা রাখে না। আত্মচরিত, জীবনচরিত, আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ইত্যাদি বহুবিধ ধারায় লেখককে জানার একটা প্রচেষ্টা অব্যাহত ভাবে চলে আসছে বহুকাল ধরে, তাতে লাভ লোকসান কতখানি হলো তা নিয়ে বিতর্কের অবসান কখনোই হবে না। শেক্সপীয়র নাট্যমঞ্চের বাইরে গাড়ি পাহারা দিতেন না শিক্ষকতা করতেন তা তাঁর ট্রাজেডি, কমেডি বা সনেট প্রসঙ্গে আলোচ্য বিষয় নয়, অন্যদিকে নজরুলের সাহিত্য আলোচনা প্রসঙ্গে কবির জীবনচরিত স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে। উদাহরণ বাড়ানো হল না। কারণ, আসল উদ্দেশ্য শ্রীকান্ত; শুধু শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নন, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস নিয়ে আলোচনাই বর্তমান প্রবন্ধের সীমাবদ্ধতা। তবে ‘শ্রীকান্ত’কে উপন্যাস অভিধা দিয়ে শুরু করার অর্থ বিতর্ককে দিয়েই আলোচনার সূত্রপাত। কারণ এটি ‘উপন্যাস’, ‘আত্মজীবনী’, নাকি ‘আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস’, তা নিয়ে বিতর্ক কখনোই শেষ হবে না। শ্রীকান্তের কতখানি শরৎচন্দ্রে অথবা শরৎচন্দ্রের কতখানি শ্রীকান্তের মধ্যে প্রভাবিত তা আলোচনাই মুখ্য।
শ্রীকান্ত উপন্যাসে শরৎচন্দ্রের জীবনকাহিনী আছে ভাবলে একটু ভুল হবে, বরং এতে আছে তাঁর চোখে দেখা নানা ঘটনার বর্ণনা, এ কারণে উপন্যাস হিসেবে এর গঠনশৈলী যথেষ্ট শিথিল। যাইহোক, শরৎচন্দ্র নিজে শ্রীকান্ত বা শ্রীকান্ত নিজে শরৎচন্দ্র এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই; তবে শ্রীকান্তর অনেকটাই শরৎচন্দ্র বা শরৎচন্দ্রের অনেকটাই শ্রীকান্ত– এই কথা ভাবা যেতেই পারে। শরৎচন্দ্রের অনেক উপন্যাসেই স্বয়ং তিনি আছেন বা তাঁর চোখে দেখা আছে– এমন দাবি অসঙ্গত নয়।
হুগলি জেলার দেবানন্দপুরে জন্মগ্রহণ করলেও শরৎচন্দ্রের ছোটবেলা কেটেছে মামারবাড়ি ভাগলপুরে। সেখানে পাঠশালার এক ছাত্রীর সঙ্গে তাঁর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। শরৎচন্দ্রকে ছায়ার মতো অনুসরণ করত সে, ছিপ নিয়ে মাছ ধরা, নৌকা করে বেড়ানো, বৈঁচি ফল পেড়ে মালা গাঁথা সবই করতে সে, যে পরবর্তীকালে রাজলক্ষ্মী বা পিয়ারী বাঈজী রূপে স্থান পায় শ্রীকান্ত উপন্যাসে। তবে মেয়েটিকে প্রায় অবিকৃত রূপে পাওয়া যায় দেবদাস ও পারুলের মধ্যে। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে শরৎচন্দ্রই কি দেবদাস? এ প্রশ্নের আলোচনা এখানে মুখ্য নয়। তবে শ্রীকান্তর মতো শরৎচন্দ্রও বাল্যকালে মেধাবী ও দুরন্ত ছিলেন, তবে মনে ছিল এক কোমল মানবিকতার স্বভাব। ছোটবেলার রাজু বা রাজেন্দ্রনাথ ছিলেন শরৎচন্দ্রের প্রিয় সঙ্গী, যাকে শ্রীকান্ত উপন্যাসে ইন্দ্রনাথ রূপে দেখা যায়। রাজু ছিলেন ধনী ব্যক্তির ছেলে, তবে পরোপকারী, দুঃসাহসী ও সৎসাহসী। শরৎচন্দ্রের কাছে তিনি একদিকে বন্ধু অন্যদিকে অভিভাবক, আবার পথপ্রদর্শকও। রাজুর বর্ণনায় পাওয়া যায় ‘গভীর রাতে আমবাগান হইতে বাঁশী বাজিয়া উঠিত, সবাই জানিত রাজুর অগম্য স্থান নাই, সে সাপের ভয় করিত না– বোধ করি মৃত্যুর ভয়ও ছিল না’ ইন্দ্রনাথের বর্ণনার সঙ্গে যার প্রায় হুবহু মিল আছে। এই রাজু যেমন একদিন আকস্মিকভাবে বৈরাগী হয়ে সংসার ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, উপন্যাসে ইন্দ্রনাথের জীবনেও তার ব্যত্যয় ঘটে না।
বাবার মৃত্যুর পর শরৎচন্দ্র ব্রহ্মদেশে চলে যান। সেখানে তিনি বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। রেঙ্গুনে থাকার সময় আইনজীবী কুঞ্জবিহারী বন্দোপাধ্যায়ের বাড়িতে একদিন দুটি যুবক ও একটি তরুণী এসে আশ্রয় নেয়। তরুণীটির নাম গায়ত্রী, সে সুন্দরী শান্ত ও কোমলস্বভাবা। যে যুবকটি তার স্বামী বলে পরিচয় দেয়, সে আসলে তার স্বামী নয়, প্রতিবেশী মাত্র; মেয়েটির অসহায়তার সুযোগে তাকে ফুঁসলে নিয়ে চলে এসেছিল। গায়ত্রীর প্রতিরূপ অভয়া এবং যুবকের প্রতিভূস্বরূপ লেখকের প্রতিবেশী রোহিণীর মিল আছে। আবার মজফফরপুরের জমিদার মহাদেব সাহুর সঙ্গে শরৎচন্দ্রের পরিচয় হয়েছিল, তিনিই ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে কুমারবাহাদুর, যার শিকার পার্টিতে এসে পিয়ারী বাঈজীর সঙ্গে শ্রীকান্তর দেখা। উল্লেখ্য, শ্রীকান্তর সন্ন্যাস জীবনের সঙ্গে লেখকের সন্ন্যাস তথা বোহেমিয়ান জীবনের যথেষ্ট মিল আছে। শ্রীকান্তর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা জুড়ে আছেন অন্নদাদিদি। শরৎচন্দ্রের সম্পর্কে এক ভাগ্নি অন্নদাদিদির চরিত্র নির্মাণে সহায়ক হয়েছে। এছাড়াও মেজদা, নতুনদা, টগর, রোহিণী প্রভৃতি চরিত্র নির্মাণেও শরৎচন্দ্রের দেখা চরিত্রগুলির নাম পরিবর্তিত হয়ে স্থান পেয়েছে তাঁর উপন্যাসে। ‘শ্রীকান্ত’ তাই আত্মজীবনী বা আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস কিনা তা আলোচনার বিতর্কিত প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বলা যায় শ্রীকান্তর অর্ধেক আকাশ জুড়ে শরৎচন্দ্র, আর শরৎচন্দ্রের ভবঘুরে জীবন জুড়ে শ্রীকান্তর অর্ধেক উপস্থিতি।