
ঋদ্ধিমান রায়, আগামী কলরব: ভারতের অকথিত ইতিহাস কাহিনীগুলির উপর ছবি তৈরি করা নিয়ে ঝোঁক ক্রমশ বাড়ছে বলিউডে। আগামী জানুয়ারীর ১০ তারিখ মুক্তি পেতে চলেছে অজয় দেবগণ অভিনীত ছবি Tanhaji The unsung warrior. সম্প্রতি ছবিটির ট্রেলার মুক্তি পাওয়ার পর সেটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, পাশাপাশি গড়ে উঠেছে নানা আলোচনা সমালোচনাও। আর এই সবের মধ্যে উন্মুক্ত হয়ে গেছে ভারতের ইতিহাসের সম্পূর্ণ অজ্ঞাত একটি অধ্যায়। ছত্রপতি শিবাজী ভারতের হৃদয়ে স্থান করে নিলেও অজানা ছিল শিবাজী মহারাজের অন্তরঙ্গ বন্ধু তানাজি মালুসরের আত্মত্যাগের কাহিনী। কিন্তু টিম ‘তানাজি দ্য অংসাং ওয়ারিয়র’ এর প্রয়াসে আজ সকলের মনে তানাজি মালুসরেকে নিয়ে কৌতূহল, প্রশ্ন। সেই সূত্রে আমরাও জেনে নেব এই মহান দেশপ্রেমিকের কীর্তির কথা।
তানাজি মালুসরের জন্ম মহারাষ্ট্রের সতারা জেলার গোদুলি গ্রামে হয়। তানাজি ছিলেন শিবাজী মহারাজের ছেলেবেলাকার অন্তরঙ্গ বন্ধু। বিদেশী শাসনের বন্ধন ছিন্ন করে ভারতকে অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার যে স্বপ্ন ছিল শিবাজী মহারাজের, তানাজি ছিলেন তাঁর সেই স্বপ্নের অন্ধ সমর্থক তথা অংশীদার। তানাজির বীরত্ব ও যুদ্ধকৌশলের নিপুনতার পরিচয় পেয়ে শিবাজী তাঁকে তাঁর সেনাদলের সেনাপতি ও মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রধান সুবেদার পদে আসীন করেন।
মারাঠা সাম্রাজ্যের সম্মান বলে পরিচিত কোন্ডানা দুর্গ পৃথিবীর দুর্গম দুর্গ গুলির মধ্যে অন্যতম। এই দুর্গটি শিবাজী মহারাজের হাত থেকে চলে যায় ঔরংজেবের হাতে। প্রবল জাত্যাভিমানী জীজা মাতা কোন্ডানা দুর্গের চূড়ায় বিদেশী মোগলের নিশান সহ্য করতে পারেন না। তিনি শিবাজিকে যেনতেনপ্রকারেণ দুর্গটি পুনরায় মারাঠা সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্তি করার আদেশ দেন। মায়ের আদেশ ছত্রপতি শিবাজীর কাছে ছিল অলঙ্ঘনীয়।
কিন্তু ইচ্ছা হলেই মুঠোয় পাওয়া যায় এমন দুর্গ ছিল না কোন্ডানা। কূটনীতি-শ্রেষ্ঠ শিবাজী মহারাজও পড়লেন দুশ্চিন্তায়। একদিকে কোন্ডানা দুর্গ চতুর্দিকে খাড়া পাহাড়বেষ্টিত, সেই সঙ্গে দুর্গে সদাজাগ্রত পাঁচ হাজার মোগল সৈনিক, যার নেতৃত্বে ধুরন্ধর যুদ্ধবাজ রাজপুত উদয়ভান সিং রাঠোর। এই পরিস্থিতিতে শিবাজী অনেক ভাবনাচিন্তা করে খবর পাঠালেন প্রিয় বন্ধু তানাজির কাছে।
সেই সময় ছেলের বিয়ের উৎসব নিয়ে তানাজি ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু শিবাজী মহারাজের বার্তা পেয়ে নির্দ্বিধায় বিয়ের আয়োজন অন্যদের কাঁধে চাপিয়ে তানাজি বেরিয়ে পড়লেন শিবাজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। সাক্ষাতে শিবাজী ও জীজামাতাকে আশ্বস্ত করে তাঁদের প্রতিশ্রুতি দিলেন কোন্ডানা দুর্গ পুনরুদ্ধার করার।

৪ঠা ফেব্রুয়ারি ১৬৭০ সাল। সীমিত সেনার কথা মাথায় রেখেই কোন্ডানা আক্রমণের পরিকল্পনা করলেন তানাজি। দুর্গের পশ্চিম দিক অত্যন্ত খাড়া পাথরের চাঁই দিয়ে সুরক্ষিত। ফলে এই অংশটি দিয়ে শত্রু দুর্গ আক্রমণ করতে পারে এমন সম্ভাবনা ছিল না। এই কারণে সেই দিকে তেমন পাহাড়া রাখা হত না। এই সুযোগটাই কাজে লাগাতে চাইছিলেন তানাজি। পরিকল্পনা করা হল, মাঝ রাতে কয়েকশো সৈনিক নিয়ে পাথরের চাঁই বেয়ে উঠে অতর্কিতে হামলা করে মোগল সেনাকে পর্যুদস্ত করে ফেলা।
সেই মত গভীর রাতে কোন্ডানা দুর্গের পশ্চিম ভাগে নিজের পোষা পাহাড়ী গিরগিটির সঙ্গে দড়ি বেঁধে তার সাহায্যে পাথর বেয়ে উঠতে শুরু করলেন তানাজি সহ তাঁর ৩৪২ জন মারাঠা সৈনিক। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পাথর বেয়ে উঠতে থাকলেও খানিকক্ষণের মধ্যেই মোগল সেনার কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যায়। নীচে তখনও একশ সৈনিক সহ অন্যতম সেনাপতি শেলার মামা এবং তানাজির ভাই সুরয়াজী। এই অবস্থায় উপরে ওঠা সামান্য সৈন্য নিয়েই মোগল সেনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন তানাজি। সংখ্যায় অতি নগণ্য হয়েও মারাঠা সেনার সুনিপুণ যুদ্ধকৌশলে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়তে থাকে মোগল সেনা।
ইতিমধ্যে তানাজির সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে আসেন দুর্গের অধিপতি উদয়ভান। উঁচু পাথর চড়ার পর দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন তানাজি। উদয়ভানের তরোয়ালের আঘাতে ভেঙে যায় তাঁর ঢাল। তখন নিজের মাথার পাগড়ি খুলে হাতে জড়িয়ে নিয়ে সেটাই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আত্মরক্ষা করতে থাকেন তিনি। এই ভাবে নিজে যুদ্ধ করতে করতে গান গেয়ে সেনাদেরও মনোবল বাড়াতে থাকেন তানাজি। কিন্তু অবশেষে ঢালের কাজ পাগড়ি দিয়ে চালাতে অসমর্থ হন, প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে এলিয়ে পড়েন তানাজি। উদয়ভান হত্যা করে ফেলেন তাঁকে। তবে মৃত্যুর পূর্বে উদয়ভানকেও যথেষ্ট আহত করে যান তিনি, যার ফলে শেলার মামা সহজেই বধ করেন উদয়ভানকে।
ততক্ষণে বাকি মারাঠা সেনাও পাথর বেয়ে উঠে পড়ে। খুলে ফেলা হয় দুর্গের প্রধান দ্বার। বাইরে থেকে সুরয়াজীর নেতৃত্বে আরো মারাঠা সেনা দুর্গে প্রবেশ করে কচুকাটা করতে থাকে মোগল সেনাদের। উদয়ভানের মৃত্যুর পর মনোবল হারিয়ে ফেলে বাকি মোগল সেনা আত্মসমর্পণ করে ফেলে। সেই রাতেই কোন্ডানা দুর্গের চূড়ায় তোলা হয় গৈরিক ধবজ।
অভূতপূর্ব এই সাফল্যের সংবাদ পেয়ে শিবাজী মহারাজ স্বয়ং বেরিয়ে পড়েন কোন্ডানার উদ্দেশ্যে, তানাজিকে অভিনন্দন জানাতে। কিন্তু সেখানে পৌঁছে বন্ধুর ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ দেখে দুঃখে ফেটে পড়েন তিনি। মুহূর্তে আনন্দ পরিবর্তিত হয় বিষাদে। আক্ষেপের সুরে ছত্রপতি শিবাজী বলেন,”গড় আলা, পন সিং গেলা!” অর্থাৎ, ‘দুর্গ এল, কিন্তু সিংহ মারা গেল।’ সেই থেকে কোন্ডানা দুর্গের নাম পরিবর্তন করে তানাজির আত্মত্যাগকে স্মরণ করে শিবাজী সেই দুর্গের নাম রাখেন সিংহ গড়।
বর্তমানে ঐতিহাসিক তথা বিশ্লেষকেরা রাতের অন্ধকারের কোন্ডানা দুর্গে তানাজির এই অতর্কিত হামলা করে জয় পাওয়ার ঘটনাকে বিশ্বের প্রথম সার্জিক্যাল স্ট্রাইক বলে মনে করেন। সবশেষে বলা যায় টিম ‘Tanhaji The unsung warrior’ এর দৌলতে ভারতের বীর্যগাথার একটি সুপ্ত অধ্যায়কে পুনরাবিষ্কার করা সম্ভব হল, সেই সঙ্গে এক দুর্লভ সাহসী যোদ্ধা তথা দেশপ্রেমিককেও।
One thought on “১৬৭০ সালে তানাজির কোন্ডানা দুর্গ আক্রমণ ছিল এক সার্জিক্যাল স্ট্রাইক”