
শ্রী অরবিন্দ ও শ্রীমায়ের জীবনকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত এই ধারাবাহিকটি ইতিমধ্যে পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছে। আমাদের বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠকমণ্ডলীর মধ্যে শ্রী অরবিন্দ ও মায়ের জীবনী নিয়ে চর্চা করেন কিংবা শ্রী অরবিন্দ আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত পাঠকও রয়েছেন নিশ্চয়ই। তাঁদের প্রতি আমাদের বিনম্র আবেদন যে, ধারাবাহিকটি পড়তে পড়তে কোনোরকম তথ্যভিত্তিক ত্রুটি চোখে পড়লে অনুগ্রহ করে তৎক্ষণাৎ আমাদের দপ্তরে যোগাযোগ করুন, অথবা লেখার শেষে কমেন্টেও জানাতে পারেন। এছাড়া লেখার নীচে দেওয়া লেখকের ফোন নম্বরে সরাসরি করতে পারেন যোগাযোগ। আমরা ত্রুটি মেরামতে সদা সচেষ্ট। –সম্পাদক
চেতনার অবতরণ(চ)
মুকুল কুমার সাহা: গত পর্বে আমরা চেতনার অবতরণ(ঙ) সম্পর্কে কিছু আলোচনা করেছিলাম। সেই আলোচনাটি পাঠকেরা ঠিক মত না বুঝতে পারলে আশ্রমসাধক নলিনীকান্ত গুপ্তের লেখাটি বুঝতে অসুবিধা হতে পারে। তাই, পাঠকদের কাছে একান্ত অনুরোধ, গত সপ্তাহের পর্বটি নীচের লিঙ্কে গিয়ে পড়েই এই পর্বটি শুরু করবেন।
এই যে অবতরণের কথা আমরা বললাম তা হল চেতনার সাধারণ বা নৈর্ব্যক্তিক অবতরণ। চেতনার আবার আছে বিশিষ্ট ব্যক্তিভূত অবতরণ। চেতনা কেবল চেতনা মাত্র নয়, তা হল আবার চিন্ময় পুরুষ।
চেতনার যে সকল শক্তিধারা সত্তার বা সৃষ্টির নানা স্তরে কাজ করে, তারা কেবল নিরাকার নিরবয়ব নৈর্ব্যক্তিক শক্তির স্রোত নয়, তারা হল আবার সাকার সাবয়ব– স্থূল না হলেও সূক্ষ্ম– ব্যক্তি রূপি শক্তি। আদি মূল সত্য– সচ্চিদানন্দ– কেবল একটা তত্ত্ব নয়; সচ্চিদানন্দ আবার সচ্চিদানন্দময় ও সচ্চিদানন্দময়ী। সচ্চিদানন্দ কেবল সৎ-চিৎ-আনন্দের সমষ্টিমাত্র নয়, তা আবার পুরুষোত্তম ও পরাশক্তি আদ্যাশক্তি। সৃষ্টি বা প্রকাশ তাই আদ্যাশক্তির ইচ্ছাবেগ, সেই ইচ্ছাকে ধরে আছে সমর্থন করছে অনুপ্রাণিত করছে পুরুষোত্তমের অনুমতি ও অনুমোদন। ভগবান- ভগবতী, আদি-পিতা আদি-মাতা হল আদি ব্যক্তি রূপ।
জরাভিমুখী গতির ধারায় সত্তা যেমন খন্ডিত বহুল হয়ে চলেছে, চেতনা যেমন ক্রমাচ্ছন্ন হয়ে কেন্দ্রে কেন্দ্রে অনন্যমুখী হয়ে ডুবে চলেছে, ব্যক্তিরূপও সেই সঙ্গে সীমাবদ্ধ ক্ষয়িত বিকৃত চূর্ণ হয়ে চলেছে। প্রথমে পূর্ণ পুরুষ, পরম ব্যক্তি– ভগবান-ভগবতী। তারপর বিজ্ঞানময় লোকে– যেখানে সৃষ্টির সত্যস্বরূপময় প্রথম প্রকাশ, বহুত্বের বীজ আবির্ভাব, যেখানে এক বহু হয়েও এক, বহু বহু হয়েও একই, প্রত্যেকের ভিতরে একের সমগ্রতা সমানভাবে ও সম্পূর্ণরূপে প্রকট ও সক্রিয়, যদিও বিচিত্র ধারায়– সেই বিজ্ঞানময় লোকে ব্যক্তির মূল স্বরূপ, আদি প্রথম প্রকাশ, তাহল ভগবান-ভগবতীর নিজেরই বিভিন্ন স্বরূপ বা বিগ্রহ। এইখানেই ভগবানের যে চতুর্ব্যুহ (বৈষ্ণব শাস্ত্রের অনুসরণে শ্রী অরবিন্দ যাদের নাম দিয়েছেন মহাবীর, বলরাম, প্রদ্যুম্ন, অনিরুদ্ধ) ও ভগবতীর যে চতুঃশক্তি (মহেশ্বরী, মহাকালী, মহালক্ষ্মী, মহাসরস্বতী), তাদের স্বধাম বা কর্মভূমি বা পাদপীঠ। তারপর অধিমানস– অধিমানসের অধিষ্ঠাত্রী যেসকল ব্যক্তি-শক্তি তাঁরাই হলেন যাদের সাধারণত বলা হয় দেবতা। বৈদিক ঋষিরা মনে হয় এঁদের সন্ধান পেয়েছিলেন এবং এঁদেরই সঙ্গে একটা সাক্ষাত জীবন্ত সংযোগস্থাপন করতে পেরেছিলেন। এখানেও, অধিমানসের উত্তরস্তরে, মন্ত্র হল–
একং সৎ বিপ্রা বহুধা বদন্তি
অগ্নিং য়মং মাতরিশ্বানমাহুঃ
—ঋকবেদ ১–১৬৪–৪৬

এখানেও বিশ্ব দেবতা একই দেবের নানা ক্রিয়ামূর্তি– একই দেব হলেন সহস্রশীর্ষ সহস্রপাদ। তবুও দেবতারা এখানে যথেষ্ট পৃথক হয়েছেন, নিজের নিজের বৈশিষ্ট্য স্বাতন্ত্র লাভ করেছেন, প্রত্যেকের পূজা-অর্চনার স্তব-স্তুতি-তুষ্টির বিশেষ ধারা পরিস্ফুট হয়েছে। ইউরোপীয়রা এই জিনিসটির নাম দিয়েছেন Henotheism অর্থাৎ যখন যে দেবতাকে পূজা করা হয় তখন তিনিi হয়ে ওঠেন সর্বেসর্বা সর্বপ্রধান। এরপরে মনোময় স্তরে এসে অথবা অধিমানসের নিম্নতর স্তর থেকেই দেবশক্তিরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে, হয়েছে সুর আর অসুর, পৌরাণিক দেবতা আর দানব। এক হল যারা পূর্বেকার একাত্মক উর্দ্ধতর চেতনার স্মৃতি এখনো রেখেছে আর হল যারা শেষ স্মৃতি মুছে ফেলে দিয়েছে, হয়ে উঠেছে মূর্তিমান স্বাতন্ত্র স্বৈরতা অহংকার। এক অদিতির, আর হল দিতির সন্তান। অদিতি অর্থ অখণ্ডতা অভিন্নতা, অবিচ্ছিন্নতা, দিতি অর্থ খণ্ডতা বিচ্ছিন্নতা।
প্রাচীন সকল ধর্ম-ঐতিহ্যে এই তত্ত্বটির উল্লেখ আছে দেখা যায়, নানা রূপকের কাহিনীর আবরণ অন্তরালে। পারসিকদের আহ্রিমান ও অরহুমজাদ, ইহুদিদের জিহোবা ও শয়তান, গ্রীকদের অলিম্পিয়ান ও টাইটান হল অদিতি-দিতির, জ্যোতির ও তমিস্রার দ্বৈধ ধারা। গ্রিক ঐতিহ্যে আছে টাইটান প্রমেথেউ (Prometheus) স্বর্গ হতে আগুন অপহরণ করে এনেছিলেন মানুষের সেবার জন্য। ইহুদীরা বলে আদিমানুষ– আদম– স্বর্গের উদ্যানে নিষ্কলুষ ছিল– শয়তান তাকে জ্ঞানের ফল খাইয়ে প্রথম পাপের স্বাদ জাগিয়ে দিয়েছিল। এইসব গাথারই অর্থ আমরা যে বলেছি চেতনার একটা অবতরণ ও অবনতি। ঐকাত্মক মানসোত্তর রাজ্য থেকে খণ্ডত্বধর্মী মানসের মধ্যে সত্তার ও চেতনার ক্রমনিমজ্জন ঘটেছে এবং ফলে হয়েছে অহং-এর অন্ধতার আবির্ভাব। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে শাঙ্খের তত্ত্বক্রম– মহৎতত্ত্বের পর অহম; মহৎ হল সর্বব্যাপক অখণ্ডচেতনা আর সে চেতনা যখন খণ্ড ও সংকীর্ণ ও একমুখী হয়েছে তখনই জন্মেছে অহম।
(দ্বিবিংশ পর্ব আগামী রবিবার)
লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন- 8584063724
২০ম পর্বটি পড়তে ক্লিক করুন- https://agamikalarab.com/2020/03/08/
One thought on “ধারাবাহিক রচনা: আমাদের শ্রী অরবিন্দ(পর্ব-২১)”