
শ্রী অরবিন্দ ও শ্রীমায়ের জীবনকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত এই ধারাবাহিকটি ইতিমধ্যে পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছে। আমাদের বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠকমণ্ডলীর মধ্যে শ্রী অরবিন্দ ও মায়ের জীবনী নিয়ে চর্চা করেন কিংবা শ্রী অরবিন্দ আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত পাঠকও রয়েছেন নিশ্চয়ই। তাঁদের প্রতি আমাদের বিনম্র আবেদন যে, ধারাবাহিকটি পড়তে পড়তে কোনোরকম তথ্যভিত্তিক ত্রুটি চোখে পড়লে অনুগ্রহ করে তৎক্ষণাৎ আমাদের দপ্তরে যোগাযোগ করুন, অথবা লেখার শেষে কমেন্টেও জানাতে পারেন। এছাড়া লেখার নীচে দেওয়া লেখকের ফোন নম্বরে সরাসরি করতে পারেন যোগাযোগ। আমরা ত্রুটি মেরামতে সদা সচেষ্ট। –সম্পাদক
মুকুল কুমার সাহা: ‘চেতনার অবতরণ’ এর ছ পর্বে আমরা দেখলাম, চেতনা মন থেকে প্রাণে নেমে এসেছে। মন ও প্রাণের সন্ধিস্থলে রয়েছে এক ধরনের জীব, তাদের নাম দেওয়া হয়েছে অসুর। প্রাণের মধ্যভাগে যে জীব রয়েছে তাদের নাম দেওয়া হয়েছে রাক্ষস। প্রাণের অন্য এক দিকে রয়েছে যক্ষ-রক্ষ-গন্ধর্ব-কিন্নর প্রভৃতি। প্রাণের অধমাঙ্গের জীবদের বলা হয় পিশাচ-জিন-দানা প্রভৃতি। প্রাণ যখন জড়কে স্পর্শ করছে সেখানেও বিভিন্ন ব্যক্তিসত্তা রয়েছে। সবশেষে একান্ত জড়ের স্তরে ব্যক্তিসত্তা নেই।
তারপরে বিবর্তনের ধারা শুরু হয়েছে। তখন ব্যক্তিত্ব জিনিসটিও গড়ে উঠেছে এক নবতর আকৃতি প্রকৃতি নিয়ে। প্রাণীর মধ্যে এসে ব্যষ্টিত্ব দেখা দিয়েছে, মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে ব্যক্তিত্ব।
তাহলে যত জগতে যত জীব রয়েছে সে সব সূক্ষ্ম ও স্থূল যাই হোক না কেন, তারা ভালো বা মন্দ যাই হোক, সবাই ভগবান থেকেই এসেছে এটাই বোঝা যায়। যে সব জীবেরা ভগবানের সঙ্গে একটা সম্পর্ক রেখে চলেছে তারাই দেবতা। আর যারা নিজেরা ভগবান থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে স্বপ্রতিষ্ঠিত হতে চেষ্টা করেছে, তারা হয়ে উঠেছে আত্মমুখী ও আত্মভোগপরায়ণ। তারাই ভগবত-বিরোধী শক্তি।
চেতনার অবতরণ পর্ব (জ)
মানুষের আগে পর্যন্ত যে ব্যষ্টিত্ব জন্ম নিয়েছে, ক্রমে পরিপুষ্ট হয়েছে, তার উদ্দেশ্য হল এমন একটা কাঠামো তৈরি করা যার মধ্যে এসে ব্যক্তিত্ব ধরা দিতে পারে, তার কাজ করতে পারে। মানুষের সমুন্নত সুসংগঠিত দেহখানিও ঠিক এই রকমেরই প্রকৃতির একটা সুদীর্ঘকালব্যাপী প্রয়াসের ও সাধনার পরিণতি। পরিপুষ্ট দেহে পরিপুষ্ট ব্যষ্টিত্ব ( অর্থাৎ কেবল দেহ নয়, দেহ প্রাণ ও মনের একটা বৈশিষ্ট্যময় সংগঠন) ফুটে উঠেছে এবং পরিপুষ্ট ব্যষ্টিত্বে আবির্ভূত হয়েছে ব্যক্তিত্ব। দেহ যদি ব্যষ্টিত্বের আধার, ব্যষ্টিত্ব তবে ব্যক্তিত্বের আধার। এই ব্যক্তিত্ব কী? জিজ্ঞাসা তবে করতে হয় আধারের আধেয় কী? এখানে আমাদের বলতে হবে আরেক অবতরণের কথা– চেতনার চতুর্থ অবতরণ।

এই অবতরণ ঘটেছে মানুষের হৃদয়ে– অন্তর্হৃদয়ে। মানুষের মনুষ্যত্ব বা ব্যক্তিত্ব অর্থ হৃদ পুরুষের আবির্ভাব। আমি বলেছি প্রাণ ও মনের সন্ধিস্থল হৃদয়– তা হল হৃদয়াবেগের ভাবালুতার ক্ষেত্র; কিন্তু এ হৃদয়ের বহিরঙ্গ। হৃদপিণ্ড যেমন সমস্ত শরীরকে সতেজ সক্রিয় রেখেছে, এক করে রেখেছে– উপনিষদে যেমন বলে আধারের শত নাড়ি হৃদয়ে এসে মিলেছে– তেমনি অন্তর্হৃদয়ে মানুষের সমগ্র আধারকে, মন বুদ্ধি হতে ইন্দ্রিয় পর্যন্ত যাবতীয় অঙ্গকে, একটা সমষ্টিগত সুষম অখণ্ড আকার দিয়েছে, নিয়ন্ত্রিত পরিচালিত করেছে। এই অন্তর্হৃদয় মানুষেরই আছে, আর কোনও সত্তার কি জীবের নাই– মনোময় স্তরের অহংমূর্তি অসুরের এ হৃদয় নাই, প্রাণময় স্তরের যক্ষ রক্ষেরও নাই, পার্থিব প্রাণীর উচ্চতম শ্রেণীর মধ্যেও ঠিক এই জিনিসটি নাই। মানুষের মধ্যে এই অভিনব সৃষ্টি। কারণ মানবাধারে এ যে সশরীরে– অর্থাৎ স্বরূপে– অবতীর্ণ হয়েছে, উচ্চতম পশুর মধ্যে বড়জোর পাওয়া যায় এর খণ্ড প্রকাশ, বিক্ষিপ্ত বৃত্তি অনিশ্চিত রেখা (মানুষের নিজেরই মধ্যে যেমন তার ঊর্ধ্বস্থ অধিমানস চেতনার প্রকাশ এখানে- ওখানে এখন-তখন দেখা যায় বটে কিন্তু অধিমানস স্বয়ং সেখানে নামে নাই)। প্রাণীর মধ্যে– উচ্চতর পশুর হৃদ কেন্দ্রে– “চৈত্যসত্তা” ক্রমে দেখা দিয়েছে বটে, কিন্তু– “চৈতপুরুষ” দেখা দেয় নাই। অন্তর্হৃদয়ের চৈতপুরুষের পূর্ণ অবতরণের একটি অভূতপূর্ব সার্থকতা হল এই যে মানুষের মধ্যে রূপান্তরের, সজ্ঞান ও স্বেচ্ছাকৃত রূপান্তরের সম্ভাবনা এসেছে। এই অবতরণের ফলেই মানুষের মধ্যে জেগেছে যে আত্ম-সম্বিৎ তা কেবল আত্মজ্ঞানে নয় তা আবার ঊর্ধ্বমুখী আত্মশক্তি অর্থাৎ সে নিজেকে নিজে ঘুরে এখন দেখতে পায় এবং সেই সঙ্গে নিজের উপর নিজে একটা দিব্য-ভাবে কাজ করতেও পারে। বিবর্তনের পূর্ব পূর্ব স্তরে এক পদবী হতে আর এক পদবীতে উঠতে হলে মৃত্যুর ভেতর দিয়ে যেতে হত এবং তা ঘটতে পারত সজ্ঞানে নয় অজ্ঞানে। কোনও বন মানুষ নিজেকে পরিবর্তিত করে করে মানুষে পরিণত হয় নাই– এমন কখনও ঘটেনাই যে আজ যে বনমানুষ কাল বা পরশু সে মানুষ হয়ে উঠেছে। বনমানুষের পরে মানুষ দেখা দিয়েছে নিশ্চয়ই, কিন্তু মানুষ যখন দেখা দিয়েছে তখন মানুষ রূপে এসে দেখা দিয়েছে তখন মানুষ রূপেই সে দেখা দিয়েছে। সে যা হোক, মানুষ কিন্তু এখন আর এক পদবীতে ধাপে– দেবত্বে উঠতে চায়, তবে সে তা পারে মানুষ থেকেই, মানুষের পরিবর্তন সাধন করে, একই আধারের মধ্যে; এ জন্য তাকে মৃত্যুর দুয়ার পার হতে হয় না।
(চতুর্বিংশ পর্ব আগামী রবিবার)
লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন- 8584063724
২২ম পর্বটি পড়তে ক্লিক করুন- https://agamikalarab.com/2020/04/15
One thought on “ধারাবাহিক রচনা: আমাদের শ্রী অরবিন্দ(পর্ব-২৩)”