
“মিনতি আবার অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তার শিরায় উপশিরায় রোগের সঙ্গে বাসা বেঁধেছে বেদনা। তার ইচ্ছে হলে হয়ত সে আবার সুস্থ হয়ে উঠতো। কিন্তু সে মন থেকে আর সুস্থ হতে চায় না। এই বিশাল পৃথিবীর ছোট্ট সমাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে মিনতি।”
প্রসেনজিৎ মজুমদার: রহিম মাধ্যমিক পাস করার পর শহরের এক স্কুলের একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়। স্কুলের সাথে সাথে বাড়িতেও একটি টিউশনিতে ভর্তি হয়।
এখানে প্রত্যেকটা বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা মাস্টার। প্রচুর ছেলেমেয়েরা একসাথে পড়ে, যেনো এও এক স্কুল। এখানে একটি মেয়ে মিনতি, পড়াশোনাতে খুব ভালো। রহিমও পড়াশোনাতে খুব একটা খারাপ যায় না। রহিমের সাথে মিনতির খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়। মাস্টারমশাইরা মিনতিকে ভালোবাসতেন, কারণ মিনতি রোজ ক্লাসে পড়া দিত। তবে রহিমকে মাঝেমধ্যে বকাও খেতে হত।
যাই হোক, গল্প মিনতি কে নিয়ে।
মিনতি মাঝেমধ্যেই পড়তে আসা বন্ধ করত এবং পরে এসে রহিমের কাছ থেকে নোটস নিয়ে নিত। কিন্তু মিনতির এ পড়া বন্ধ করা, যেন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। প্রায় সে পড়া বন্ধ করত। আর কারণ জিজ্ঞাসা করলে অজুহাত দিত অসুস্থতার।
এর কিছুদিন পর আবার মিনতি পড়া বন্ধ করল এবার যে পড়া বন্ধ করল। তা আর এক-দুদিনের জন্য নয়। দেখতে দেখতে দুমাস পার হয়ে যায়। মাস্টারমশাইরা মিনতির বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলে কেউ কোন উত্তর দিতে পারে না। এমন কি তার বাড়িও কেউ চেনে না, যে গিয়ে তার খোঁজ নেবে, কেন মিনতি পড়তে আসে না।
দেখতে দেখতে ক্লাসের ফাইনাল ইয়ার চলে আসে, পরীক্ষার ঠিক আগের মুহূর্তে একদিন বাংলা ক্লাসে অন্য এক মাস্টারমশাই এসে জানালেন যে মিনতি গত তিন মাস ধরে হসপিটালে ভর্তি। বাংলার মাস্টারমশাই সহ সব ছেলেমেয়েরা অবাক হয়ে গেল। ছেলেমেয়েদের মধ্যে কৌতূহল বাসা বাঁধলো। প্রত্যেকের মনে একই প্রশ্ন, কী হয়েছে মিনতির? একটা থমথমে পরিস্থিতির মধ্যে মাস্টারমশাই সবাইকে বললেন,’মিনতি থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত, মাসে মাসে তাকে রক্ত দিতে হয়। রক্তের জন্য অনেক টাকার দরকার। কিন্তু তার বাড়ির অবস্থা ভালো নয়। মিনতি বাবা একজন বাস কন্ডাক্টর। মেয়ের চিকিৎসার জন্য জমানো টাকা-পয়সা সবকিছু শেষ করে দিয়েছে। এখন তোমরা যে যা পারবে কিছু কিছু টাকা সাহায্য করে তোমাদের এই বন্ধুকে আবার তোমাদের পাশে ফিরিয়ে আনো। আমাদের সকলের আশীর্বাদ আর তোমাদের প্রার্থনায় সে নিশ্চয়ই ভালো হয়ে যাবে।’
সকলের চেষ্টায় এবং পাড়ার লোকেদের সাহায্যে সে ধীরে ধীরে অনেকটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে। তাকে দেখলে কে বলবে যে কয়েকদিন আগেই জীবন-মৃত্যুর কিনারায় দাঁড়িয়ে ছিল!
একাদশ শ্রেণির পরীক্ষা শেষ, সে পরীক্ষা দিতে পারে নি। মিনতি যেহেতু পড়াশোনাতে ভালো, তাই স্কুলের হেড মিস্ট্রেস এর কাছে পরীক্ষা দেওয়ার আবেদন জানিয়েছিল।
ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে কিছুদিন হল। মিনতি অকারণে একটা বছর নষ্ট হতে দিতে চায় না।
স্কুলের হেডমিস্ট্রেস তার পরীক্ষার আবেদন মঞ্জুর করলেন। পরীক্ষার জন্য এক মাস সময়ও দিলেন।
সে কিছুতেই হারতে চায় না। জন্ম থেকে এই রোগের সাথে লড়াই করে সফল হয়েছে, ক্লাসে বছরের পর বছর প্রথম স্থান দখল করে রেখেছে। তার শরীর ঠিক থাকলে হয়তো এবছরও প্রথম হত। তার জীবনের সময় অতি মূল্যবান। তাই সে কিছুতে সময় নষ্ট করতে চায় না।
সব ঠিক ঠাকই ছিল,
বিপত্তি ঘটলো পরীক্ষা ঠিক আগের দিন স্কুলে। হেডমিস্ট্রেস তাকে জানিয়ে দিলেন যে সে পরীক্ষা দিতে পারবে না। স্কুলের বেশ কয়েকজন সহশিক্ষিকা এবং সম্পাদকমন্ডলী এই পরীক্ষা নিতে দেবেন না। তিনি এও জানিয়ে দিলেন তাঁর পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়।
কথাটা শুনে মিনতির দুচোখ ভরে গেল জলে। চোখের জল ফেলতে ফেলতে সে নিরুপায় হয়ে বাড়ি ফিরে এল।
আবার নতুন করে তাকে পড়া শুরু করতে হবে নতুনদের সাথে। তার চোখের সামনে তার বন্ধুরা উঁচু ক্লাসে পড়বে, এটা সে কিছুতেই মানতে পারবে না।
দিনের-পর-দিন মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছিল সে। মাঝে একদিন রহিমের সাথে দেখা হয় মিনতির। রহিম তার মুখে সমস্ত কথা শুনে তাকে বোঝালো, তাকে নতুন করে ভাবতে প্রেরণা জোগাল। কিন্তু মিনতি কিছুতেই নিজেকে শক্ত করে রাখতে পারছে না। সে যে বাঁচার জন্য! সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য! তার শরীরটাকে ইস্পাতের মতো কঠিন করে রেখেছিল। আজ তা এক উড়ো ঝড়ে শেষ হতে বসেছে।
সে মেনে নিতে পারেনি। তার, নিজের জীবনের প্রতি ঘৃণা জন্মে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে সে আবার অসুস্থ হয়ে পড়ল।
ওই ছোট্ট মেয়েটির তার স্বপ্নকে কোথায় যেন হারিয়ে ফেলে।
মিনতি আবার অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তার শিরায় উপশিরায় রোগের সঙ্গে বাসা বেঁধেছে বেদনা। তার ইচ্ছে হলে হয়ত সে আবার সুস্থ হয়ে উঠতো। কিন্তু সে মন থেকে আর সুস্থ হতে চায় না। এই বিশাল পৃথিবীর ছোট্ট সমাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে মিনতি। দীর্ঘদিন ধরে কঠিন রোগের সাথে সংঘর্ষ করতে করতে ও আজকের মত এত ক্লান্তি দুর্বলতা আগে অনুভব করে নি। সে এবার জীবনটা আনন্দ উল্লাসে কাটাতে চায়। তাই মিনতি পৃথিবী থেকে মুক্তি নিল।