
প্রিয়াঙ্কা সিংহ: কলকাতায় এখন ফ্ল্যাট বাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি। এসব বাড়িতে ফেরিওয়ালাদের প্রবেশাধিকার নেই। দোকান থেকে বাড়িতে বিনা পয়সাতে জিনিস পৌঁছান দোকানদার। আর আজ-কাল তো অনলাইনেই সব কিছু পৌঁছায় বাড়িতে। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে, আজ থেকে একশ বছর আগে এই ফেরিওয়ালারাই ছিল শহর কলকাতার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ!
উনিশ শতকের কলকাতায় সকাল থেকে শুরু হয়ে যেত ফেরিওয়ালার আনাগোনা। ফেরিওয়ালাদের সাইন বোর্ড হল তাদের হাঁক-ডাক। উনিশ শতকের কলকাতার রাস্তাতে অলিগলিতে ফেরিওয়ালাদের যে সব ডাক শোনা যেত সেগুলো ছিল এই রকম – ‘সরাগুড়, তিলকুটো, সন্দেশ, মুকুন্দ মোয়া’, ‘বাত ভালো করি’, ‘দাঁতের পোকা বার করি’, ‘মাজন,’ ‘চাই শাঁখা ,চাই সিঁদুর’ , ‘চাই দই ,ভালো দই’ ইত্যাদি ইত্যাদি ।
মরসুম বদলানোর সাথে সাথে ফেরিওয়ালার ফিরি করার জিনিস বদলে যেত। গরম কালে আমওয়ালা হাঁকত ‘চাই ল্যাংড়া আম, ফজলি আম’। শোনা যেত ‘লে লে বাবু, মুজাফরপুরকা লিচি’। এরা ছিল প্রধানত বিহারী (মুখে ‘হিন্দুস্থানী’ প্রচলিত) ফেরিওয়ালা। গরম কালে বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শোনা যেত ‘বরফ, মালাই কুলফি বরফ, রাবড়ির কুলফি বরফ’– এর ডাক। মাঝরাতে ‘কালো কুলফি বরফ’ এর ডাক শোনা যেত, সেটা ছিল সিদ্ধির কুলফি। পাশাপাশি শোনা যেত ‘চাই বেল ফুলের মালা’ জাতীয় ডাক ।
শীতকালে এই ডাক বদল হত। শোনা যেত ‘জয়নগরের মোয়া, পাতালি গুড়’ জাতীয় ডাক ।
শহর কলকাতার বয়সের বেড়ে ওঠার সাথে অনেক কিছু পালটাতে থাকে। মানুষের প্রয়োজন ও রুচি বদলাতে থাকে। কাঁসার বদলে স্টিলের বাসনের চলন হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে গেছে ‘কাঁসার বাসন চাই’ ডাকও।
এক সময় ফেরিওালারা বিলিতি চুড়ি, সাবান ফিরি করত। এখন সবই অনলাইন। পাউরুটি, বিস্কুট ফেরিওয়ালারা কোথাও কোথাও টিকে থাকলেও এরাও এখন অদৃশ্য হওয়ার পথে ।
সেকালের কলকাতার সাহেব পাড়াতে দেখা যেত চীনা ফেরিওয়ালাদের । এরা ফেরি করতো জাপানি সিল্ক, চীনে কোট,পাজামা ইত্যাদি। মেম সাহেবরা খুব পছন্দ করত এদের থেকে কিনতে।
কলকাতাতে একটা সময় কাবুলিওয়ালারাও হিং, পেস্তা, বাদাম আর শুকনো মেওয়া ফেরি করত। ‘শিশি-বোতল বিক্রি আছে’ জাতীয় হাঁকডাক কাদের সে কথা আজও বিশদ ভাবে বুঝিয়ে বলতে হয় না।
ফেরিওয়ালা আমাদের নিত্যদিনের পরিচিত মুখ। তাদের সবকিছুই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে বা কানে বেজে ওঠে। তারা নানা স্বরে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করেন। সারা দিন রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে তারা ফেরি করে বেড়ান। আমাদের দেশে এঁরা শহরের অঙ্গ, আর কলকাতা শহরের তো বটেই।