
ঋদ্ধিমান রায়, আগামী কলরব: লক ডাউনের ক্লান্তিময় একঘেয়ে জীবনের নাগপাশে বন্দী সমাজের কর্মচঞ্চলতার প্রাণভ্রমরটি। আজ মূল্যহীন রবিবার! পয়লা বৈশাখের মত বাঙালিত্বের মাটিমাখা দিন পর্যন্ত আমাদের কেটেছে টিভির পর্দায় করোনা আক্রান্তের হিসেব কষা দেখতে দেখতে।
গত ১৪ই এপ্রিল দেশ জুড়ে লক ডাউনের মধ্যেও কমবেশি পালিত হয়েছে বাবাসাহেব আম্বেদকরের জন্মদিবস। এইরকম জরুরি পরিস্থিতির মধ্যেও এক কথায় বঞ্চিত হতে হয় নি ভারতীয় সংবিধানের জনককে। বাবাসাহেবের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা জানিয়েও বলতে হয়, ১৪ই এপ্রিল তারিখটি প্রত্যেক ভারতীয়ের শরীরের এক এক ফোঁটা রক্ত ও শিরা-উপশিরার সঙ্গে জড়িয়ে ওতপ্রোত ভাবে অন্য একটি কারণে! দুর্ভাগ্য যে, ১৪ই এপ্রিলের সেই দুর্বার আকর্ষণটি সম্পর্কে আমরা অধিকাংশ ভারতীয়ই বিস্মৃত। বোধ করি লক ডাউনের অলস মুহূর্তের কিছুটা সময় ফ্ল্যাশ ব্যাকে ফিরে যেতে আমাদের অসুবিধা হবে না!
আমরা রক্তে লেখা ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসের টাইম মেশিনে করে ফিরে যাচ্ছি ১৯৪৪ সালের ১৪ই এপ্রিল। স্থান– অজস্র পাহাড়-টিলায় ঘেরা জঙ্গলাকীর্ণ মণিপুরের মৈরাং। পড়ন্ত সূর্যের গৈরিক আভা সাক্ষী ঘন্টাখানেক ধরে চলা তুমুল এক যুদ্ধের! একদিকে দুর্ধর্ষ ব্রিটিশ সেনা, অন্যদিকে ভারতমায়ের কাছে বলিপ্রদত্ত আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনারা। ব্রিটিশ সেনারা অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত, সংখ্যায় অনেক। তবু সেদিন সেই অসম যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীকে আজাদ হিন্দ ফৌজের কাছে কচুকাটা হতে দেখল মৈরাং।
অবশেষে ভারতের মাটিতে সেদিন ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা উড়ল কর্নেল এস.এ মালিকের নেতৃত্বে। সেই সঙ্গে সেদিন দেশের মাটির দখল নিল ভারতের স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে সিঙ্গাপুরের মাটিতে গঠিত আজাদ হিন্দ সরকার, যার প্রধান ছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। এরপর মৈরাং এই প্রতিষ্ঠিত হয় আজাদ হিন্দ ফৌজের হেড কোয়ার্টার।
আপাতভাবে ঘটনাটি বিশেষ নজরে না আসলেও আমরা যদি এর ঐতিহাসিক মূল্য সম্পর্কে সচেতন হই, তাহলে আমাদের শরীরের প্রতিটা রোম পর্যন্ত উপলব্ধি করতে পারবে ১৪ই এপ্রিলের মাহাত্ম্য। আরো একবার ইতিহাস রাজনৈতিক বেসাতির হাট থেকে বেরিয়ে এসে আত্মপ্রকাশ করবে স্বমহিমায়।
ইতিহাস দেখাতে সক্ষম হবে ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট প্রাপ্ত স্বাধীনতা সাধারণ ভারতীয়দের চোখে ঠুলি গুঁজে দিয়ে গোলটেবিলে বসে ইংরেজ ও ভারতীয় নেতাদের মধ্যে চুক্তিভিত্তিক একটি ব্যবসায়িক ক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়া আর কিছুই নয়! সেখানে ইংরেজের তত্ত্বাবধানে দুজন বেনিয়ার দেশকে দু টুকরো করে নিজের পাওনা গন্ডা বুঝে নেওয়াই সার।

কিন্তু ১৯৪৪ এর ১৪ই এপ্রিল কোনোরকম দরকচাকচি কি ভিক্ষাবৃত্তি নয়, ব্রিটিশের দর্পকে মৈরাং এর মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে স্বাধীন ভারতের মাটি ছিনিয়ে নিয়েছিল আজাদ হিন্দ ফৌজ। এমনকি ভারতের প্রায় ১৫০ মাইল এলাকা আজাদ হিন্দ ফৌজ ইংরেজ-মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়। সেই সব অঞ্চলে প্রায় দেড় বছর ধরে আজাদ হিন্দ সরকারের প্রত্যক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। আজাদ হিন্দ সরকারের প্রবর্তিত ব্যাংক, নোট, ডাকটিকিটেরও প্রচলন শুরু হয় সেই সব এলাকায়।
সেই সময় দুর্নীতির পাঁকে নিমজ্জিত ভারতের প্রথম সারির নেতারা আজাদ হিন্দ সরকারকে সাহায্য করলে হয়ত আজকের চুক্তিভিত্তিক দু টুকরো জমি লাভ নয়, অখণ্ড ভারতের মাটিতেই ইংরেজদের উৎখাত করা সম্ভবপর হত। কোটি কোটি মানুষের রক্ত ও চোখের জলের বিনিময়ে স্বাধীন হতে হত না। অবশ্য, ১৯৪৫ এর পরবর্তীতে নেতাজী ভীতিই যে ইংরেজকে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের টেবিলে বসতে বাধ্য করায় এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
যাই হোক, মৈরাং এর আজাদ হিন্দ ফৌজের হেডকোয়ার্টারটিকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে আই.এন.এ এর স্মৃতিতে মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করা হয়। সিঙ্গাপুরে নেতাজী আজাদ হিন্দ ফৌজের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে যে শহীদ বেদীটি তৈরি করিয়েছিলেন, তার আদলে একটি শহীদ বেদীও প্রতিষ্ঠা করা হয় সেখানে।
ইতিহাসের চাকা নিজের গতিতে এগিয়ে যায়, সেই গতি রোধ করা সম্ভব নয়। রোধ করতে প্রয়াসী হলে ইতিহাসের চাকা তাকে নির্মম ভাবে পিষে দিয়ে যায়! দীর্ঘদিন ধরে কংগ্রেস-কমিউনিস্ট সরকারের চাটুকার ঐতিহাসিকদের তৈরি করা অসত্য ইতিহাস ভারতের স্বাধীনতা লাভে নেতাজী ও আজাদ হিন্দ সরকারের ভূমিকার কথা চেপে রেখেছিল গান্ধীজির অলীক চরকা-কাটা স্বাধীনতার গালগল্পের নীচে! আজ সেই অবদমিত আজাদ হিন্দ ফৌজের আত্মবলিদানের উত্তপ্ত রক্ত শান্তিময় চরকার কাঠে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে। অখণ্ড ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা ইতিহাস নেতাজীর হাতেই তুলে দিয়েছে।
আমরা জানি ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। সেই বিশ্বাস থেকেই ধরে নেওয়া যেতে পারে, কোটি মানুষের রক্তে নিন্দিত ১৫ই আগস্টের টুকরো করা রাজনৈতিক বোঝাপড়া নয়; ভারতের প্রকৃত স্বাধীনতার দিন হিসেবে ভবিষ্যতের ইতিহাস স্বীকৃতি দেবে ১৯৪৪ এর ১৪ই এপ্রিলকেই, যেদিন উদ্ধত ইংরেজের হাঁটু ভেঙে দিয়ে ভারত ভূমির দখল নিয়েছিল ভারতেরই জাতীয় সরকার! নেতাজীর অমোঘ গর্জন সেদিন প্রতিষ্ঠা পাবে– স্বাধীনতা কোনো ভিক্ষার জিনিস নয়, যা দানে পাওয়া যায়। স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে হয়।