
শ্রী অরবিন্দ ও শ্রীমায়ের জীবনকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত এই ধারাবাহিকটি ইতিমধ্যে পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছে। আমাদের বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠকমণ্ডলীর মধ্যে শ্রী অরবিন্দ ও মায়ের জীবনী নিয়ে চর্চা করেন কিংবা শ্রী অরবিন্দ আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত পাঠকও রয়েছেন নিশ্চয়ই। তাঁদের প্রতি আমাদের বিনম্র আবেদন যে, ধারাবাহিকটি পড়তে পড়তে কোনোরকম তথ্যভিত্তিক ত্রুটি চোখে পড়লে অনুগ্রহ করে তৎক্ষণাৎ আমাদের দপ্তরে যোগাযোগ করুন, অথবা লেখার শেষে কমেন্টেও জানাতে পারেন। এছাড়া লেখার নীচে দেওয়া লেখকের ফোন নম্বরে সরাসরি করতে পারেন যোগাযোগ। আমরা ত্রুটি মেরামতে সদা সচেষ্ট। –সম্পাদক
মুকুল কুমার সাহা: আশ্রম সাধক নলিনীকান্ত গুপ্তের রচনাবলীর অষ্টম খণ্ড থেকে নেওয়া ‘চেতনার অবতরণ’ পর্বটি আমাদের এই পর্বেই শেষ হচ্ছে। শ্রী অরবিন্দ এবং শ্রীমার যোগপথে নিবেদিত অগ্রণীসাধক নলিনীকান্ত গুপ্তের অষ্টম খণ্ডের বিভিন্ন পর্ব থেকে কিছু কিছু করে নিয়ে আমার পরবর্তী পর্ব গুলো রচনা করব বলে ঠিক করেছি। আমার পরের পর্বগুলো পড়ে কারোর মনে যদি অতৃপ্তি থেকে যায়, তাহলে তাঁরা মূল বইটি পড়ে নিলেই সমস্ত কিছু বিশদে জানতে পারবেন এই আশা রাখি।
বিভিন্ন যোগ মার্গের মহাপুরুষদের কথা থেকে বা লেখনী থেকে যা যা প্রকাশিত হয়েছে খুব যত্ন করে মনোযোগ সহকারে সেগুলি পড়তে থাকলে (মূল বই অথবা উপযুক্ত অনুবাদের মাধ্যমে) বুঝতে অসুবিধা হয় না ভগবান বা ভগবতী জননী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পরিবেশে কত রকম ভাবে নিজেকে প্রকাশ করেছেন বা করে চলেছেন।
গত পর্বে জানা গেছে আমাদের অন্তরাত্মা বা চৈত্য পুরুষের পরিপুষ্টির জন্য অনেক অনেক জন্ম-মৃত্যুর প্রয়োজন হয়। চৈত্য পুরুষ যখন জন্ম জন্মান্তরের পথ পার হয়ে নিজ দেহ-প্রাণ-মনের কর্তা হয়ে উঠতে সক্ষম হয়, তখনই মানুষের ব্যক্তিরূপ নব নব সিদ্ধির প্রকাশলীলায় অংশগ্রহণে সমর্থ হয়।
চেতনার অবতরণ (অন্তিম পর্ব)

ঊর্ধ্ব হতে চারটি অবতরণের ফলে আমরা তবে দেখলাম সৃষ্টি হয়েছে ও চলেছে– চলেছে উত্তরণের দিকে, কিন্তু ক্রম লয় নয়, ক্রম রূপান্তরের দিকে। অবতরণের শেষ আরেকটি ধারা এখনো রয়ে গিয়েছে– এই পঞ্চম অবতরণ হল যেন উত্তম এর চেয়েও উত্তম রহস্য, উত্তমোত্তম বা পরাৎপর রহস্য। কী তবে সে জিনিস? তা হল ভগবানের, সচ্চিদানন্দময় পুরুষোত্তমের নিজের অবতরণ তার ব্যক্তিরূপে– তাঁর সাধারণ বা ব্যাপক সত্তা ও চেতনা হিসেবে নয়, কিংবা তাঁর সৃষ্ট বা তাঁর অংশ জীবের আধারকে আশ্রয় করে নয়– তাঁর আপন ভাগবত ব্যক্তিত্বেরই সাক্ষাৎ অবতরণ। অবতার বলতে আমরা সচরাচর এই জিনিসটিই বুঝে থাকি। পূর্ণ ভগবান দেহধারী ব্যক্তিরূপ নিয়ে অবতীর্ণ হন এই পার্থিব আয়তনে জড়সৃষ্টির মধ্যে, বিবর্তনের ধারায় একটা বিশেষ ঊর্ধ্বায়ন, একটা ক্রমান্তর একটা রূপান্তর ও ধর্মান্তর সাধনের জন্য। মানবীয় স্তরে তিনি মানুষী তনু গ্রহণ করেন তার দুই উদ্দেশ্য– প্রথম, নিজের জীবন ধারায় দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখান কী রকমে প্রকৃতির পরিবর্তন সাধিত হয়, কী রকমে একটা নিম্নতর চেতনা থেকে ঊর্ধ্বতর স্তরে উন্নীত হওয়া যায়– ভগবানের আরেক নাম তাই যোগেশ্বর; কারণ, যোগ হল সেই সজ্ঞান সাধনা যার বলে নিজের সত্তা ঊর্ধ্বায়িত হয়ে যুক্ত হয় উপরের সত্তায়। তাঁর দৃষ্টান্তের মানুষও তাঁর পথ অনুসরণ করতে পারে– সে প্রেরণা সে জ্ঞান তার সুলভ হয়। ভগবানের শরীর গ্রহণের দ্বিতীয়— এবং গুহ্যতর– উদ্দেশ্য ও সার্থকতা হল এই যে জড়কে জড়ায়তনকে কেবল অধ্যাত্মচেতনার দ্বারা পরিচালিত নিয়ন্ত্রিত করা যথেষ্ট নয়, অধ্যাত্মচেতনার হাতে আয়ুধ রূপে থাকা দরকার জড়শক্তি, জড়কে জড় দিয়ে বিজিত অভিভূত করবার জন্য– ভগবতী দশভূজার হাতে দশ প্রহরণ রয়েছে কেন তবে? অবতারের দেহশক্তিই যেন প্রকৃতির প্রাকৃত দেহ শক্তিকে পরিশেষে বাধ্য করে ঊর্ধ্বায়িত রূপান্তরিত হতে।
ভগবানের অবতারী ব্যক্তিরূপ কেবল মানুষের স্তরে মানুষ-আকারেই আবদ্ধ নয়। ভারতীয় দশাবতারের চিত্রে যে পাওয়া যেতে পারে আদিকাল হতে প্রকৃতির বিবর্তনে একটা ক্রম পারস্পর্যের ইতিহাস, এ কথাটির উপর অনেকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। প্রকৃতির পরিবেশ যেরকম, চেতনার যে পরিস্থিতি তার অনুসরণে, তার প্রয়োজনের বশে ভগবতী তনু রূপ গ্রহণ করে, এবং প্রকৃতির ও চেতনার রূপান্তরের আহ্বান অনুসারে নিজের রূপান্তরেরও ক্রমবিকাশ ঘটায়।
মানবজাতির এক ভবিষ্যৎ– খুব সম্ভব এক আশু– রূপান্তরের কথা কল্কি অবতারের রূপকে বর্ণিত হয়েছে বলে মনে হয়। দ্রষ্টারা বলেছেন কল্কি আসছেন শ্বেত অশ্ব আরোহণে। শ্বেত অশ্ব হতে পারে শুভ্র চিন্ময় সক্রিয় বেগবতী শক্তি। মনোময় মানুষ এবার চিন্ময় হয়ে উঠবে, বর্তমান বিবর্তনক্রমের এই অন্তর্নিহিত প্রয়াস ও সাধনা।
(সপ্তবিংশ পর্ব আগামী রবিবার)
লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন- 8584063724
২৫ম পর্বটি পড়তে ক্লিক করুন- https://agamikalarab.com/2020/05/07