
শ্রী অরবিন্দ ও শ্রীমায়ের জীবনকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত এই ধারাবাহিকটি ইতিমধ্যে পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছে। আমাদের বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠকমণ্ডলীর মধ্যে শ্রী অরবিন্দ ও মায়ের জীবনী নিয়ে চর্চা করেন কিংবা শ্রী অরবিন্দ আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত পাঠকও রয়েছেন নিশ্চয়ই। তাঁদের প্রতি আমাদের বিনম্র আবেদন যে, ধারাবাহিকটি পড়তে পড়তে কোনোরকম তথ্যভিত্তিক ত্রুটি চোখে পড়লে অনুগ্রহ করে তৎক্ষণাৎ আমাদের দপ্তরে যোগাযোগ করুন, অথবা লেখার শেষে কমেন্টেও জানাতে পারেন। এছাড়া লেখার নীচে দেওয়া লেখকের ফোন নম্বরে সরাসরি করতে পারেন যোগাযোগ। আমরা ত্রুটি মেরামতে সদা সচেষ্ট। –সম্পাদক
যোগ সাধনার উদ্দেশ্য
মুকুল কুমার সাহা: আমরা আগের পর্বে যোগ কী, সেই বিষয়ে আলোচনা করছিলাম। স্বাভাবিক ভাবেই ভগবান প্রসঙ্গ এসে পড়েছে আমাদের আলোচনায়। ‘চেতনার অবতরণ পর্ব’ পড়ে আমরা জেনেছি, সচ্চিদানন্দ (ব্রহ্ম) কেবলই সৎ-চিৎ-আনন্দের সমষ্টি, নিরাকার নিরাবয়ব নৈর্ব্যক্তিক স্রোত নয়। তারা হল আবার সাকার সাবয়ব সূক্ষ্ম ব্যক্তিরূপী শক্তি। সচ্চিদানন্দের ব্যক্তিরূপকে বলা হয় সচ্চিদানন্দময় ও সচ্চিদানন্দময়ী (পুরুষোত্তম ও পরা শক্তি, ভগবান-ভগবতী)। যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে পরা শক্তির বা ভগবতী জননীর ইচ্ছায়, ভগবান বা পুরুষোত্তম তাঁর সৃষ্টিতে সমর্থন দিয়ে চলেছেন। ভগবান-ভগবতী জননী যে কী তা মানুষের কাছে অজ্ঞেয়। পন্ডিচেরীর শ্রী অরবিন্দ আশ্রমে একদিন এক শিশু শ্রীমার ক্লাসে শ্রীমাকেই জিজ্ঞাসা করেছিল,”মা, ভগবান কী?” উত্তরে শ্রীমা বলেছিলেন,“তুমি প্রশ্ন করতে পারো, কিন্তু উত্তর আশা কোরো না।” এর থেকেই বোঝা যায় ভগবান-ভগবতী জননীর ব্যক্তিরূপ যে কী, তা মানুষ ধারণা করতে সক্ষম নয়।
আমরা জেনেছি মানুষের সঙ্গে ভগবানের মিলনকেই যোগ বলে। হিন্দু সনাতন ধর্মে অসংখ্য প্রকার যোগের কথা উল্লেখ করা আছে, যেমন– সাংখ্য যোগ, ক্রিয়া যোগ, লয় যোগ, হঠ যোগ, রাজ যোগ, কর্ম যোগ, জ্ঞান যোগ, ভক্তি যোগ, ধ্যান যোগ, বিজ্ঞান যোগ, তন্ত্র যোগ, ব্রহ্ম যোগ, বিবেক যোগ, বিভূতি যোগ, প্রকৃতি পুরুষ যোগ, মোক্ষ যোগ, পুরুষোত্তম যোগ, রাজধিরাজ যোগ প্রভৃতি। ভারতের অন্যান্য ধর্মে ভগবানের সঙ্গে মিলনের যে পদ্ধতি তাকে তাঁদের মহাপুরুষেরা কী বলেছেন সে সম্পর্কে আমার বিস্তারিত জানা নেই।
শ্রী অরবিন্দ মানব জাতিকে যে যোগ দিয়েছেন তার নামকরণ করেছেন পূর্ণ যোগ।
এখন মনে প্রশ্ন জাগবে মানুষ ‘যোগ’ করে কেন? এর উদ্দেশ্য কী?

আমরা ‘চেতনার অবতরণ পর্ব’ পড়ে জানতে পেরেছি পূর্ণ ভগবানের আংশিক প্রকাশকে বলে জীবাত্মা। এই জীবাত্মারা ঊর্ধ্ব প্রকৃতিতে অবস্থান করেন, যাকে পরা প্রকৃতি বলা হয়। ওই জীবাত্মা থেকে আসা ক্ষুদ্র একটু অংশ মানবশরীরে অবস্থান করে, যে মানবশরীর ভগবানের নিম্ন প্রকৃতির বা অপরা প্রকৃতি থেকে সৃষ্টি হয়েছে। জীবাত্মার ক্ষুদ্র অংশকে বলা হয় অন্তরাত্মা, হৃদপুরুষ, জীব এবং শ্রী অরবিন্দ যার নাম দিয়েছেন চৈত্য সত্তা।
এই অন্তরাত্মা বা চৈত্য পুরুষ জন্ম-জন্মান্তর পার হয়ে, দুঃখ ও সুখের, তিক্ত ও মধুর যাবতীয় অভিজ্ঞতার সহায়ে তার চেতনাকে ক্রমেই বৃহত্তর বিপুলতর করে চলে। অন্তরাত্মা পূর্ণতা পাওয়ার পর সে এই অপরা প্রকৃতির জীবন চক্র আর পছন্দ করে না। সে ঠিক করে এই জীবনে এই শরীরেই সে প্রকট হবে। তখনই তার যোগসাধনার অধিকার জন্মায়।
শ্রী অরবিন্দের আগে পর্যন্ত যোগ সাধনার দুটি উদ্দেশ্য ছিল। ঋষিদের ও শ্রী অরবিন্দের লেখা থেকে জানা যায় দুটি গোলার্ধের(Hemisphere) কথা। উপরেরটা ব্রহ্মের বা ভগবানের সধাম বা দিব্য জগৎ, সেগুলি পরা প্রকৃতির অন্তর্গত। সেখানে সগুণ ও নির্গুণ অবস্থায় ভগবানের নানা রূপ, নানা চেতনা যুগপৎ বর্তমান আছে। বৈষ্ণব শাস্ত্র পড়লে এই চিন্ময় জগৎগুলির সম্পর্কে কিছু কিছু জানা যায়। বৈষ্ণবেরা বলেন– সেই জগতে সেখানকার কোনো কিছুই ধ্বংস হয় না বা নষ্ট হয় না, সেখানকার সব কিছুই পরম আনন্দময়।
শ্রী অরবিন্দের আগের যুগে যোগ সাধনার দুটি উদ্দেশ্য ছিল–১. অন্তরাত্মা বা চৈত্য সত্তা সাধন বলে নিজেকে একেবারে মুছে ফেলে ভগবানের সহিত পূর্ণ রূপে এক হয়ে যাওয়া। এই সাধনায় সিদ্ধি লাভ হলে সাধকের পৃথক অস্তিত্ব আর থাকে না, সৃষ্টির পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়।
২. অন্তরাত্মা ভগবানের সঙ্গে মিলিত হয়ে নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখে ওইসব উচ্চতর গোলার্ধে ভগবানের নিত্যলীলায় অংশগ্রহণ করতে পারে।
শ্রী অরবিন্দের পূর্ণ যোগের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে পরের পর্বে আলোচনা করা হবে।
(ত্রিংশ পর্ব আগামী রবিবার)
লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন- 8584063724
২৮ম পর্বটি পড়তে ক্লিক করুন- https://agamikalarab.com/2020/06/02