
শ্রী অরবিন্দ ও শ্রীমায়ের জীবনকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত এই ধারাবাহিকটি ইতিমধ্যে পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছে। আমাদের বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠকমণ্ডলীর মধ্যে শ্রী অরবিন্দ ও মায়ের জীবনী নিয়ে চর্চা করেন কিংবা শ্রী অরবিন্দ আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত পাঠকও রয়েছেন নিশ্চয়ই। তাঁদের প্রতি আমাদের বিনম্র আবেদন যে, ধারাবাহিকটি পড়তে পড়তে কোনোরকম তথ্যভিত্তিক ত্রুটি চোখে পড়লে অনুগ্রহ করে তৎক্ষণাৎ আমাদের দপ্তরে যোগাযোগ করুন, অথবা লেখার শেষে
কমেন্টেও জানাতে পারেন। এছাড়া লেখার নীচে দেওয়া লেখকের ফোন নম্বরে সরাসরি করতে পারেন যোগাযোগ। আমরা ত্রুটি মেরামতে সদা সচেষ্ট। –সম্পাদক
শ্রী অরবিন্দের পূর্ণ যোগের উদ্দেশ্য
মুকুল কুমার সাহা: ভারতের প্রাচীন ঋষিরা তাঁদের অভিজ্ঞতালব্ধ অধ্যাত্মজ্ঞান মানবজাতিকে বিতরণ করেছেন। শ্রী অরবিন্দ সেই বিপুল অধ্যাত্মজ্ঞানের বিভিন্নতা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেছেন। তিনি মানবজাতিকে ভগবান সম্বন্ধে, মহাপ্রকৃতি সম্বন্ধে যে শিক্ষা দান করেছেন; মানুষী ব্যষ্টি চেতনার সঙ্গে দিব্য চেতনার সম্বন্ধ স্থাপন করতে যে যোগ পন্থার পথ দেখিয়েছেন তা হল–
বিশ্বে যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে এই সমস্ত কিছু সৃষ্টির পশ্চাতে রয়েছেন ভগবান বা ভগবতী জননীর মহাচেতনা; আবার সকল সৃষ্টির ভিতরে তিনিই রয়েছেন এক অভিন্ন আত্মা রূপে। সকল সত্তা(ব্যক্তিরূপ) এই অভিন্ন আত্মার মধ্যে মিলিত। কিন্তু ভগবতী জননী তাঁর চেতনার বিভিন্নতা দিয়ে সকলকে স্বতন্ত্র রূপে বিভক্ত করেছেন। স্বতন্ত্র দেহ-প্রাণ ও মনের অজ্ঞানতা নিয়ে ঊর্ধ্বের এই আদি অনন্ত ভগবান বা সকলের ভিতরের মহান আত্মা সম্বন্ধে প্রায় সকলেই অজ্ঞ। মনস্তাত্ত্বিক যোগসাধনা দ্বারা এই স্বতন্ত্রতা ও অজ্ঞানতার আড়াল ঘুঁচিয়ে সকলের ভিতরের মহান আত্মা এবং ঊর্ধ্বের ভগবান ও ভগবতী জননীর সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করা যায়।
শ্রী অরবিন্দ বলেছেন ভগবান বা ভগবতী জননীর চেতনা এখানে এই জড়ের মধ্যেও সুপ্ত হয়ে রয়েছেন। বিবর্তন ক্রিয়ার দ্বারা তিনি নিজেকে ধীরে ধীরে উন্মোচিত করছেন। প্রথমে জড় নিশ্চেতন, এই নিশ্চেতন জড়ের মধ্যে চেতনা স্ফূরিত হয়েছে দীর্ঘকাল সময় পার করে। এই চেতনামুক্তির প্রথম ধাপ জীবনের বিকাশ। দ্বিতীয় ধাপ মনের বিকাশ(আশ্রম সাধক নলিনীকান্ত গুপ্ত তাঁর ‘চেতনার অবতরণ’ পর্বে এ সম্বন্ধে বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন, যা আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি)। মন পর্যন্ত এসেই বিবর্তন থেমে থাকবে না, এর চেয়েও বড় রকমের আধ্যাত্মিক ও অতিমানসিক চেতনা বিকাশের জন্য বিবর্তনের পরবর্তী ধাপ অপেক্ষা করছে। পরবর্তী ধাপে ভগবানের অতিমানস শক্তি পৃথিবীতে নেমে এসে এখানেই পশু মানবকে দিব্য মানবে পরিণত করবে। (শ্রী অরবিন্দ এক জায়গায় বলেছেন– অতিমানস সম্বন্ধে জ্ঞান আমি সরাসরি পেয়েছি, ধার করা নয়, তবে পরবর্তীকালে আমি বেদে ও উপনিষদে এর সঙ্গে কিছু কিছু মিল পেয়েছি)।
আগেকার ধাপগুলিতে উদ্ভিদ, পশু ও মানব সৃষ্টিতে তাদের চেতন ইচ্ছার অভাবে প্রকৃতিই বিবর্তনের ভার নিয়েছিলেন। মানুষের বেলাতে মানুষকেই যন্ত্র স্বরূপ করে তার চেতন ইচ্ছার মাধ্যমে মহাপ্রকৃতি এই কাজ করতে সক্ষম হবেন। মানুষের তরফে যে সাধনা করতে হবে, যে যোগ করতে হবে, শ্রী অরবিন্দ সেই যোগের নাম দিয়েছেন পূর্ণ যোগ। পূর্ণ যোগের উদ্দেশ্য এই পৃথিবীতেই মানুষ পূর্ণতা পাবে, পৃথিবীতেই দিব্য জীবনের সূচনা হবে। পৃথিবীই হয়ে উঠবে পরমের পরম আনন্দময় ধাম।

শ্রী অরবিন্দ তাঁর বাংলা লেখায় পূর্ণ যোগের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে নিজে যা লিখেছেন সেগুলোই তুলে দেওয়া হল–
“পূর্ণযোগের পন্থায় পদার্পণ করিয়াছ, পূর্ণ যোগের অর্থ ও উদ্দেশ্য কী তাহাই একবার তলাইয়া দেখিয়া অগ্রসর হও। সিদ্ধির উচ্চ শিখরে আরূঢ় হইবার মহৎ আকাঙ্ক্ষা যাহার, তাহার দুটিকথা সম্যক জানা প্রয়োজন, উদ্দেশ্য ও পন্থা। পন্থার কথা পরে বলিব, আগে উদ্দেশ্যের পূর্ণ চিত্র তোমাদের চোখের সামনে পূর্ণভাবে দৃঢ়রেখায় ফলান দরকার।
পূর্ণতার অর্থ কী? পূর্ণতা ভাগবতসত্তার স্বরূপ, ভগবতী প্রকৃতির ধর্ম। মানুষ অপূর্ণ, পূর্ণতার প্রয়াসী, পূর্ণতার দিকে ক্রমবিকাশ, আত্মার ক্রম অভিব্যক্তির ধারায় অগ্রসর। পূর্ণতা তাহার গন্তব্যস্থান, মানুষ ভগবানের একটি অর্ধবিকশিত রূপ সেই জন্য সে ভাগবত পূর্ণতার পথিক। এই মানুষ রূপ মুকুলে ভাগবত-পদ্মে পূর্ণতা লুক্কায়িত, তাহা ক্রমে ক্রমে আস্তে আস্তে প্রকৃতি ফুটাইতে সচেষ্ট আছে। যোগ-অভ্যাসে যোগশক্তিতে সে মহাবেগে তড়িৎ বিকাশে ফুটিতে আরম্ভ করে। লোকে যাহাকে পূর্ণ মনুষ্যত্ব বলে, মানসিক উন্নতি, নৈতিক সাধুতা, চিত্তবৃত্তির ললিত বিকাশ, চরিত্রের তেজ, প্রাণের বল, দৈহিক স্বাস্থ্য, সে ভাগবত পূর্ণতা নয়। সে প্রকৃতির একটি খণ্ড-ধর্মের পূর্ণতা। আত্মার পূর্ণতায়, মানসাতীত বিজ্ঞানশক্তির পূর্ণতায় প্রকৃত অখণ্ড পূর্ণতা আসে। কারণ, অখণ্ড আত্মাই আসল পুরুষ, মানুষের মানসিক প্রাণিক ও দৈহিক পুরুষত্ব তাহার একটি খণ্ড বিকাশ মাত্র। আর মনের বিকাশ বিজ্ঞানের একটি খণ্ড বাহ্যিক বিকৃত খেলা, মনের প্রকৃত পূর্ণতা আসে যখন সে বিজ্ঞানে পরিণত হয়। অখণ্ড আত্মা জগৎকে বিজ্ঞানশক্তি দ্বারা সৃজন করিয়া নিয়ন্ত্রিত করে, বিজ্ঞান শক্তির দ্বারা খণ্ডকে অখণ্ডে তুলিয়া দেয়। আত্মা মানুষের মধ্যে মানসরূপ পর্দায় লুক্কায়িত রহিয়াছে, পর্দা সরাইয়া আত্মার স্বরূপ দেখা দেয়। আত্মশক্তি মনে খর্ব্বাকৃত অর্ধপ্রকাশিত, অর্ধ লুক্কায়িত রূপ ও ক্রীড়া অনুভব করে, বিজ্ঞানশক্তি যখন খুলে তখনই আত্মশক্তির পূর্ণ স্ফূরণ।।”
(একত্রিংশ পর্ব আগামী রবিবার)
লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন- 8584063724
২৯ম পর্বটি পড়তে ক্লিক করুন-https://agamikalarab.com/2020/06/09