
প্রসেনজিৎ মজুমদার, আগামী কলরব: ঘড়িতে নটা বেজে আঠারো, বাড়ির বাইরে ঠান্ডা হাওয়া, সেই সঙ্গে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হয়ে চলেছে। সন্ধ্যার সময় কালবৈশাখী ঝড় বয়ে গিয়েছে, সঙ্গে মুষলধারায় বৃষ্টি। ঘরে বসে পড়ছি, এমন সময় দরজায় টোকা মারার শব্দ। এখন আবার কে এলো এই বৃষ্টির মধ্যে! বাবা টিভিতে খবর শুনছে পাশের ঘরে বসে। মা রান্না ঘরে, তাই আমাকেই দরজাটা খুলতে হল। মড়মড় শব্দে দরজাটা খুলতেই চমকে উঠলাম-- 'একি তুই? ভিজে স্নান হয়ে গেছিস যে! আয়-আয় শিগগির ভিতরে আয়।! রোহিত আমার কলেজের বন্ধু। সামনে ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষা, তাই কলেজে যাওয়া হয় না। ওর সাথে কথাও হয়নি বেশ কিছুদিন। রোহিত ঘরের ভিতরে আসে। আমি তোয়ালেটা দিয়ে বললাম 'মাথাটা মুছে ফেল, জল বসলে ঠান্ডা লেগে যাবে সামনে আবার পরীক্ষা।'
এতক্ষণ লক্ষ্য করিনি ওর বাঁ হাতের কনুই কেটে রক্ত ঝরছে মেঝেতে। ‘
কিরে, তোর হাত কাটল কীভাবে?’ রোহিত কোনও উত্তর দিল না। আমি ড্রয়ার থেকে তুলো আর ডেটল এনে তার ক্ষত জায়গা পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে দিলাম। ওর হাতটা কেমন ঠান্ডা, চামড়াও ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। বোধহয় এতক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছিল তাই। আলমারি থেকে একটা জামা বার করে দিয়ে বললাম ‘এটা পরে ফেল।’ এবার ওর মুখ ফুটে কথা বেরোলো, গলাটা ধরা ধরা– ‘না রে, আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে। অনেকদিন তোর সাথে দেখা হয়নি, তাই পরীক্ষার জন্য কেমন প্রিপারেশন নিয়েছিস জানতে এলাম।’ –‘ওহ্, তা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে খবরটা নেওয়ার খুব দরকার ছিল কি? পরেও তো নেওয়া যেত।’
মা রান্নাঘর থেকে এসে দেখলে রহিত ভিজে কাকের মত কাঁপছে। মা বলল,’তা বাবা রোহিত, তুমি এলে তো এই বৃষ্টির দিনে কেন? সেই কবে শেষবার এসেছিলে। রহিত কে কতবার বলেছি তোমাকে যেন আসতে বলে। কিন্তু তুমি তো আর এলে না। তা পরীক্ষার জন্য তৈরি তো?’ –‘এই মোটামুটি মাসিমা’, বলে রোহিত। –‘তুমি দাঁড়িয়ে কেন! বস, তোমার জন্য গরম গরম লুচি দুটো ভেজে আনি?’।
–‘না মাসিমা আমি খাব না, আমার তাড়া আছে, যেতে হবে। পরে অন্য দিন এসে গরম গরম লুচি খেয়ে যাব।’ –‘ঠিক আছে’, বলে মা রান্না ঘরে চলে গেল। আমি আর ওকে থাকার জন্য জোর করলাম না। সামনে পরীক্ষা, তার মধ্যে ভিজে রয়েছে।
দরজাটা এখনো খোলা, ঠান্ডা হওয়া ঘরে এসে ঢুকছে। রহিতকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে মনের মধ্যে কৌতূহল জাগল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোর হাতটা কাটল কীভাবে?’ ও বলল,’অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, আমার বাইকের সাথে লরির।
–‘তোর বাইকটা এখন কোথায়?’ –‘ওখানেই পড়ে আছে হয়তো।’
–‘তার মানে তুই সেটা আনিস নি!’
সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, তারপর ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে দৌড় দিল। আমার বাড়ি থেকে ওর বাড়ি মিনিট ত্রিশের দূরত্ব। কয়েক সেকেন্ডে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে সে মিলিয়ে গেল। আমি দরজা বন্ধ করে ঘরের ভিতরে ফিরে এলাম।
মনে মনে ভাবছি ও আগাগোড়াই এরকম কেয়ারলেস, একবার বাইক চালাতে গিয়ে পকেট থেকে ফোনটাই পড়ে গেল, ওর কোন মালুম নেই! চেয়ারে বসে উল্টানো বইটা সোজা করে ধরলাম। চোখে পরলো মেঝেতে রক্তের ফোঁটা। সেটা মুছতে যাব এমন সময় টেলিফোনটা বেজে উঠল। ফোন ধরে বুঝলাম রহিতের দাদা ফোন করেছে, তার গলার স্বর কেমন চাপা। সে যা শোনালো তাতে আমার সমস্ত শরীরের রক্ত বরফের মত জমাট বাঁধতে শুরু করল। পিঠের শিড়দাঁড়ায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করল। বুঝলাম হাত কাঁপছে!
রহিত বাইক নিয়ে সন্ধ্যার সময় এক্সিডেন্ট করে। মাথার পিছনে প্রচন্ড আঘাত লাগার কারণে অনস্পটেই মারা যায়। তার মৃত শরীর পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রহিতের দাদা সেখান থেকেই ফোন করেছে আমায়।
কি বলছে রহিতের দাদা! এইমাত্র সে আমার বাড়ি থেকে বেরোল। তাহলে আমি কি এতক্ষণ একটা মৃত শরীরের সাথে কথা বললাম! রিসিভারটা এখনো আমার কানে। ওদিক থেকে কোনও শব্দ নেই, মেঝেতে রক্তের ফোঁটাটা এখনো টাটকা। ঝোড়ো হাওয়ার এক ঝটকাতে ঘরের দরজাটা খুলে গিয়ে সমস্ত ঘরটা দমকা হাওয়া ওলট-পালট করছে। এর মধ্যে ফুটে উঠল এক অদ্ভুত রহস্যময় হাসি! ভয়ংকর সেই হাসি হাসতে হাসতে কে অনবরত বলে চলেছে, ‘আমি জিতেছি, আমি জিতেছি।’
এই একই শব্দ আমার চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। আর ওই হাসি আমাকে পাগল করে তুলছে! বাধ্য হয়ে কানে হাত চাপা দিলাম। মনে হল এ হাসি আমার পরিচিত। এ যে রহিত! রহিতেরই হাসি! ভাবতে চেষ্টা করলাম রোহিত কীসের জন্য এমন কথা বলছে। সে কীসের জন্য হাসছে? জিতেছেই বা কী কারণে?
মুহূর্তে চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই দিনটার কথা। মাস ছয়েক আগে একদিন কলেজে আমার সাথে রোহিতের তর্ক হয়। ওর ধারণা, যাদের অপঘাতে মৃত্যু হয় তারা নাকি অশরীরী। কিন্তু আমি মানতে চাইনি। আমার মতে অশরীরী বলে কিছুই হয় না, সব কিছুই আমাদের মনের ভুল। মনে করলে আছে, আবার মনে না করলে নেই। কিন্ত রোহিত সেটা মানেনি। তাই কি আজ রোহিত প্রমাণ করে দিয়ে গেল অশরীরী সত্যিই আছে!