
dil bechara movie Review
ঋদ্ধিমান রায়, আগামী কলরব: “জনম কব লেনা হে, মরনা কব হে, ইয়ে হম নেহি ডিসাইড কর সকতে। লেকিন কয়সে জিনা হে, ইয়ে হম ডিসাইড কর সকতে হে!”
শুক্রবার সকাল থেকে গোটা দেশ জুড়েই আবেগের পারদ চড়ছিল। নেটিজেন সহ আপামর দেশবাসীর প্রতিজ্ঞা ছিল SSR এর চির পরিচিত হাসিমুখকে শেষবারের মত পর্দায় সুপার ডুপার হিট করে তোলা। ডিজনি হটস্টারে ‘দিল বেচারা’ রিলিজ হওয়ার মিনিটখানেকের মধ্যেই ছবির দর্শকসংখ্যা পৌঁছে যায় লাখে। সিনেমা শেষ হওয়ার আগেই রিভিউ জমা পড়তে থাকে ১০ এ ১০ রেটিং এ। IMDB এর ওয়েবসাইটে রিভিউ রেট পড়ে চকচকে ৯.৭ স্টার। শেষ ছবিতে কাঁদাতে কাঁদাতে মানুষকে বেঁচে থাকতে শিখিয়ে গেলেন সুশান্ত। ট্রেলারের জনপ্রিয়তার প্রত্যাশা মতোই ‘দিল বেচারা’ চুরমার করে দিল বলিউড-হলিউডের তাবড় তাবড় ছবিগুলোকে।
এতকিছুর পরেও বুকে কড়া হাতুড়ির আঘাত পড়ে যখন উপলব্ধি হয় এই সাফল্য, এই আয়োজন যার জন্য, তিনি সশরীরে তা উপভোগ করতে অপারগ। বস্তুত, মানুষ তার প্রতিভার মূল্য পায় তখনই যখন সে আর বেঁচে থাকে না! আজ সুশান্ত সিং বেঁচে থাকলে ‘দিল বেচারা’র মত হীরের টুকরোও হয়ত ধুলো চাপা পড়ত, যেখানে আজও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে ‘কেদারনাথ’ কিংবা ‘চিছোর’ এর মত মহামূল্য ছবিগুলি। অবশ্য বক্স অফিসের বিচারে সুশান্ত সিং রাজপুতের ছবিগুলি ফ্লপ না করলেও ছবির কাহিনী, নির্দেশনা ও অভিনয়ের গুণমান অনুসারে যতটা হিট করা উচিত ছিল, ছবিগুলি কোনোভাবেই ততটা হিট করতে পারে নি। বরং অকারণ যৌনতাভরা চটুল বাণিজ্যিক ছবিগুলিকে দেখা গেছে লেঙ্গি দিয়ে বেরিয়ে যেতে।
dil bechara casting
মুকেশ ছাবড়ার প্রথম পরিচালনায় নির্মিত ১ঘন্টা ৪১ মিনিটের ছবিটি আসলে একটি হলিউড ছবি ‘The fault in our stars’ অবলম্বনে নির্মিত। ৩৮ কোটি বাজেটে তৈরি ছবিটি বর্তমান করোনা আবহের ফলে ডিজনি ও হটস্টারের ওয়েবসাইটে ৫০কোটি টাকার বাণিজ্যিক চুক্তিতে মুক্তি পেল। ১২ কোটির ব্যবসায়িক আয়ের পর অন্যান্য আনুষঙ্গিক বাণিজ্যিক চুক্তি ও ছবির গুণমানের উপর নির্ভর করেও ছবিটি উপর্যুপরি আয় করবে। অবশ্য সত্যি বলতে সমস্ত কিছুর উপরে থাকছে সুশান্ত সিং রাজপুত আবেগ!
dil bechara story

ছবিটির প্লট তৈরি হয়েছে দুই ক্যানসার আক্রান্ত যুবক-যুবতির প্রেমকে অবলম্বন করে। একাধারে রোম্যান্স, কমেডি ও ট্রাজেডির হাসি-কান্নার মেলবন্ধন করে এগিয়ে গেছে কাহিনী। জীবন সম্পর্কে নিস্পৃহ, নিরস কিজির জীবনে আসে প্রাণ ও জীবনের তারুণ্যে ভরপুর মানি। মানির স্বতঃস্ফূর্ত উদ্দামতা কিজিকে নতুন করে ভাবতে শেখায়, শেখায় বাঁচতে। কিজি, মানি ও তাদের বন্ধু জেপি ক্যানসার-আক্রান্ত হলেও আর পাঁচ জনের মত স্বপ্ন দেখে। তবে তাদের স্বপ্ন সীমিত। জেপি বন্ধু মানিকে হিরো করে একটা সিনেমা পরিচালনা করার লক্ষ্যে। কিজির স্বপ্ন তার প্রিয় মিউজিসিয়ানের সঙ্গে দেখা করা, অন্যদিকে মানির একমাত্র স্বপ্ন কিজির স্বপ্নকে রূপ দেওয়া। স্বপ্ন বাস্তবায়নের ঘাত-প্রতিঘাতে ছবির ঝলকে ঝলকে দেখা যায় ইমোশনের ঝাপসা ছটা।
ছবির ক্লাইম্যাক্সটি প্রত্যেক মানুষের জীবনে শিক্ষণীয়। ‘এক থা রাজা, এক থি রাণী। দোনো মর গয়ে, খতম কহানী‘… এই প্রচলিত মন ভোলানো কাহিনীর ঊর্ধ্বে উঠে কিজি বসুকে ‘রাজা’র মৃত্যুর পরও জীবনের কাহিনী এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার রহস্য শিখিয়ে যায় মানি। প্রাণ তথা চির যৌবনের প্রতীক হিসেবে অম্লান হয়ে যায় মানি নাকি সুশান্ত সিং রাজপুত!
‘আনন্দ’, ‘আঁখিও কি ঝরকো সে’ কিংবা ‘কল হো না হো’ ছবিগুলিতে রোগ-ব্যাধি-মৃত্যুর মাঝেও জীবনের প্রতি যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী দেখা যায়, হলিউড রিমেক হলেও দিল বেচারা কিন্তু এই ছবিগুলোর থিমকে সুন্দর ভাবে মেলবন্ধন করার প্রচেষ্টা করেছে।
dil bechara characters
ছবির মুখ্য অভিনেতাদের মধ্যে মানি ওরফে ইমানুয়েল রাজকুমার জুনিয়রের ভূমিকায় সুশান্ত সিং রাজপুত, কিজি বসুর ভূমিকায় সঞ্জনা সিঙ্ঘি, মানির বন্ধু জেপির ভূমিকায় সাহিল ভৈদ, কিজির বাবা ও মায়ের ভূমিকায় যথাক্রমে শ্বাশ্বত চট্টোপাধ্যায় এবং স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। পাশাপাশি ছোট্ট একটি সেলিব্রিটি সুরকারের চরিত্রে দেখা গেছে সঈফ আলী খানকে।
অভিনয়ে সুশান্ত সিং কিংবা সঞ্জনা সিঙ্ঘি অত্যন্ত সাবলীল, এক কথায় ন্যাচারাল। বিশেষ নজর কেড়েছেন শ্বাশ্বত-স্বস্তিকা– তাঁদের বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি মেশানো স্বাভাবিক সংলাপগুলি আপামর বাঙালি ঘরের স্নেহপরায়ণ বাবা-মায়ের আবেগ উসকে দেয়। পাশাপাশি মানি-কিজির সংলাপ ও কথোপকথনগুলি মৃত্যুর খাদের মুখে দাঁড়িয়েও জীবনের প্রতিধ্বনির শব্দ শুনতে শেখায়।
dil bechara songs

ছবির বিষয়বস্তুর সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই নির্মিত হয়েছে গানগুলি। ‘তারে গিন’ কিংবা ‘খুলকে জিনে কা‘র প্রত্যেক পংক্তি জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা তৈরি করে।
‘দিল বেচারা’র বেশ কিছু রিভিউতে লক্ষ্য করা যাচ্ছে ছবিতে তৈরি হওয়া ইমোশনকে বহুক্ষেত্রে অসংলগ্ন বা অনিয়ন্ত্রিত বলে সমালোচনা করা হচ্ছে। কিন্তু ছবিটির বিভিন্ন অংশ খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে আবেগের ঘনত্ব কোথাও অনিয়ন্ত্রিত হয় নি, বরং বলা চলে অত্যন্ত স্বাভাবিক। আসলে সব মানুষের আবেগ কখনোই সমান হতে পারে না। আর ছবিতে মারণরোগে আক্রান্ত চরিত্রদুটি যখন একে অপরকে হারাতে না চাইলেও নিশ্চিত ভাবে জানে যে তাদের কাহিনী অসম্পূর্ণই থেকে যাবে, তখন সেখানে হারাতে না চাওয়ার অসহায়তা ও ক্ষণিকের ভালোবাসার গাঢ়ত্ব স্বাভাবিকভাবে অনিয়ন্ত্রিত আবেগকেই বারে বারে জন্ম দেবে।
সব মিলিয়ে চারদিকের মহামারী ও মৃত্যুর হাতছানির মধ্যে ‘দিল বেচারা’ মানুষকে জীবনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা যোগায়। ছবির শেষের বার্তাটি মানি কিজি বসুর উদ্দেশ্যে জানিয়েছে নাকি সুশান্ত সিং রাজপুত সমগ্র মানব সমাজের উদ্দেশ্যে তার প্রভেদ করা দুষ্কর। ছবির শেষে মানি ও সুশান্ত সিং এক হয়ে গিয়ে দর্শকের দুই চোখ ভিজিয়ে দিয়েছে। কিজির প্রিয় মিউজিশিয়ানের অসম্পূর্ণ প্রেমের গানটিকে নিজের জীবন দিয়ে সম্পূর্ণ করার জন্যই হয়ত ক্ষণজন্মা মানির কিজির জীবনে আকস্মিক আগমন! অন্তিম প্রান্তে এসে মনে হওয়া স্বাভাবিক– জীবনের শেষ ছবিতে কি হাসতে হাসতেই বেঁচে থাকার চাবিকাঠিটি আমাদের হাতে তুলে দিয়ে গেল মানি ওরফে সুশান্ত? কিংবা জীবনের মদিরতা ছড়িয়ে দিয়ে গেলেন মানুষের অসম্পূর্ণ কাহিনীতে!