
শ্রী অরবিন্দ ও শ্রীমায়ের জীবনকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত এই ধারাবাহিকটি ইতিমধ্যে পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছে। আমাদের বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠকমণ্ডলীর মধ্যে শ্রী অরবিন্দ ও মায়ের জীবনী নিয়ে চর্চা করেন কিংবা শ্রী অরবিন্দ আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত পাঠকও রয়েছেন নিশ্চয়ই। তাঁদের প্রতি আমাদের বিনম্র আবেদন যে, ধারাবাহিকটি পড়তে পড়তে কোনোরকম তথ্যভিত্তিক ত্রুটি চোখে পড়লে অনুগ্রহ করে তৎক্ষণাৎ আমাদের দপ্তরে যোগাযোগ করুন, অথবা লেখার শেষে কমেন্টেও জানাতে পারেন। এছাড়া লেখার নীচে দেওয়া লেখকের ফোন নম্বরে সরাসরি করতে পারেন যোগাযোগ। আমরা ত্রুটি মেরামতে সদা সচেষ্ট। –সম্পাাদক
ভক্তি যোগ
মুকুল কুমার সাহা: হঠ যোগ সাধনার প্রতিষ্ঠা শরীর ও প্রাণ, রাজ যোগের প্রতিষ্ঠা চিত্ত, জ্ঞান যোগের প্রতিষ্ঠা বুদ্ধি, তেমনই ভক্তি যোগের প্রতিষ্ঠা মানুষের হৃদয়, ভালোবাসার বৃত্তি।
ভগবানকে ভালোবেসে তাঁকে লাভ করা যায়, এই সহজ সত্যটি ভক্তি যোগের ভিত্তি।
ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তিকর কোনো কিছুকে ভালোবাসা মানুষের স্বভাবসিদ্ধ কাজ। আমাদের ঘর সংসার, আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী, অর্থ, প্রতিপত্তি, সমাজ ও দেশ প্রভৃতির সঙ্গে আমাদের সরাসরি যোগাযোগ; এই সবের প্রতি আমাদের প্রচণ্ড আসক্তি। এই আসক্তি থেকেই আমাদের কর্মের প্রেরণা আসে, আর এর প্রভাবেই আমাদের জীবন পরিচালিত হয়, আমাদের নিজেদের চরিত্র নিরূপিত হয়। উপরোক্ত এইসব বিষয়গুলিকে আমরা ভালোবাসি বলেই তো এগুলোর প্রতি আমাদের অন্তরের এত টান। এই ভালোবাসা মানুষের হৃদয়ের মূল বৃত্তি। মানব জীবনে এর প্রভাব অপরিসীম। এই ভালোবাসার ইন্ধনে মানবের হৃদয়ে আবেগ প্রজ্জ্বলিত হয়, মানুষের মহৎ ও ঘৃণ্য সমুদয় কাজের প্রেরণা আসে এই পরম আবেগটি হতে, হৃদয় দ্বারাই মানুষ প্রকৃতপক্ষে পরিচালিত হয়।
ভক্তি মার্গ বলছে, মানুষ যা কিছুকে ভালবাসছে, ওই ভালোবাসার জায়গাটা শুধু পরিবর্তন করে স্থাপন করো ভগবানকে। মানুষ খুঁজছে ভালোবাসার পূর্ণ তৃপ্তি। এই পূর্ণ তৃপ্তি আছে ভগবানের মধ্যে। ভগবান হচ্ছেন পূর্ণ প্রেম, অখণ্ড ভোগ মূর্তি এবং পরম সুন্দর। পরম আনন্দ আছে একমাত্র ভগবানেরই মধ্যে। তাই হৃদয়বৃত্তিকে বিক্ষিপ্ত হতে না দিয়ে ভগবানের দিকেই পরিচালিত করতে পারলে, মানুষের নিজেরই অন্তরের নিগূঢ়ে রয়েছেন যে রসরাজ ভগবান তাঁর দিকেই একাগ্র চিত্ত হতে পারলে মানুষ মুক্তি লাভ করতে পারে।
ভক্তি মার্গ বলছে ভক্তের পথ হচ্ছে আত্মসমর্পণ। নিজেকে পরিবর্তিত করতে হলে হৃদয়ের ভালোবাসার টানের মধ্য দিয়ে ভগবানের কাছে আত্মসমর্পণ করাই সহজ ও আশু ফলপ্রদপথ।

কিন্তু যে ভগবানকে কখনো দেখি নি, অনুভব করি নি, তাঁকে ভালোবাসব কীভাবে? এই জন্য, ভগবানের প্রতি অনুরাগ প্রগাঢ় করার উদ্দেশ্যে ভক্তি যোগ মার্গে অনেকরকম সাধনার ব্যবস্থা দেওয়া আছে। এই রকম সাধনার ফলে ক্রমে ক্রমে মনের সূচিতা বৃদ্ধি পায় এবং তখন ভগবানের প্রতি আন্তরিক টান উপস্থিত হয়। নানা সম্বন্ধের বন্ধনে মানুষ নিজেকে জড়িয়ে হৃদয়ের ভালোবাসা ঢেলে দিচ্ছে। পিতামাতার প্রতি পুত্রের ভালোবাসা, প্রভুর প্রতি দাসের ভক্তি, সখার প্রতি সখার অনুরাগ, সন্তানের প্রতি মাতার স্নেহ, পতির প্রতি সাধ্বী পত্নীর ভালোবাসা। ভক্তি মার্গ বলছে ভগবানকেও এইরূপ যে কোনোভাবে ভালোবাসা যেতে পারে– শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর প্রেমের রসের এই পঞ্চধা ভাবে। এই ভাবে সাধনা করতে করতে ভগবানের প্রতি অনুরাগপুষ্ট হয়ে পরাভক্তিতে পরিণত হলে তখন সাধক সত্যই প্রেম, আনন্দ ও সৌন্দর্যের আকর ভগবানকে লাভ করেন। এটাই ভক্তি যোগের পরম প্রাপ্তি।
ভক্তি মার্গ আবার এ কথাও বলছে, ভগবানকে শুধু মিত্রভাবেই নয়, শত্রুভাবেও তাঁর সাধনা করে তাঁকে লাভ করা যায়। আমাদের অন্তরের যত অশুদ্ধতা, বিকৃতি প্রভৃতি দিয়ে যখন ভগবানের বিরুদ্ধাচরণ করা হয়, তখন তিনি এক আঘাতে সেই সমস্ত অশুদ্ধতাকে চূর্ণ করে দেওয়ার সুযোগ পান। ভগবানের সঙ্গে শত্রু ভাবে হোক, মিত্রভাবে হোক, একটা গভীর সম্পর্ক স্থাপন করাই মূল লক্ষ্য হওয়া চাই।
ভক্ত জগৎকে অস্বীকার করেন না, জগৎকে তিনি ভগবানেরই লীলার বাহ্য মূর্তি বলে দেখেন। ভগবানের সঙ্গে জ্ঞানীর সম্বন্ধ একেবারে অতীন্দ্রিয়ে সৃষ্টির বাইরে। ভগবানের সঙ্গে ভক্তের সম্বন্ধ সৃষ্টির মধ্যে ইন্দ্রিয় পরিচালিত জীবনে। ভক্ত বলেন, মানুষের যে রূপ তৃষা, ভোগ-বাসনা, ইন্দ্রিয় পরিচালিত জীবন, তার মধ্যেই ভগবানের ভোগেচ্ছা লুক্কায়িত, তাঁরই আনন্দ স্ফূরিত। তাই এ সকলকে ছেড়ে নয় এসবকে শুদ্ধ ও পরিপূর্ণ করে পৃথিবীতে ভাগবৎজীবন পাওয়া যায়, অন্তিমে ভগবানের ঊর্ধ্বের পরমানন্দ সৃষ্টির মধ্যে ভগবানের পার্ষদ হয়ে থাকবার যোগ্যতা অর্জন করা যায়।
(ষটত্রিংশ পর্ব আগামী রবিবার)
লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন- 8584063724
৩৪ তম পর্বটি পড়তে ক্লিক করুন–https://agamikalarab.com/2020/07/28/gyan-yoga/