
শ্রী অরবিন্দ ও শ্রীমায়ের জীবনকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত এই ধারাবাহিকটি ইতিমধ্যে পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছে। আমাদের বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠকমণ্ডলীর মধ্যে শ্রী অরবিন্দ ও মায়ের জীবনী নিয়ে চর্চা করেন কিংবা শ্রী অরবিন্দ আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত পাঠকও রয়েছেন নিশ্চয়ই। তাঁদের প্রতি আমাদের বিনম্র আবেদন যে, ধারাবাহিকটি পড়তে পড়তে কোনোরকম তথ্যভিত্তিক ত্রুটি চোখে পড়লে অনুগ্রহ করে তৎক্ষণাৎ আমাদের দপ্তরে যোগাযোগ করুন, অথবা লেখার শেষে কমেন্টেও জানাতে পারেন। এছাড়া লেখার নীচে দেওয়া লেখকের ফোন নম্বরে সরাসরি করতে পারেন যোগাযোগ। আমরা ত্রুটি মেরামতে সদা সচেষ্ট। –সম্পাাদক
তন্ত্র যোগ
মুকুল কুমার সাহা: এতদিন আমরা যে কটি যোগ সম্বন্ধে আলোচনা করেছি, প্রত্যেকটি যোগের উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃতিকে উপেক্ষা করা, জগতের খেলা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা, সরিয়ে ফেলা। তান্ত্রিক যোগ প্রকৃতিকে জগৎ শক্তির সমস্ত খেলাকেই সত্য বলে আনন্দপূর্ণ বলে আলিঙ্গন করে। অন্যান্য যোগ মার্গ প্রকৃতিকে জানে মায়াময়ী বলে। তন্ত্র কিন্তু প্রকৃতিকে জানে চিন্ময়ী বলে।
আমাদের সাধারণ প্রাকৃত জীবনের যে অসম্পূর্ণতা, আধারের যে অসামর্থ মলিনতা, তাকে দূরে সরিয়ে রেখে নিগ্রহ করে বিভিন্ন যোগ মার্গ ধ্যানে, মনের একাগ্রতায় আধারের অন্তরালে অতীতে যে স্থানু নিত্য শুদ্ধ পূর্ণ অদ্বৈত জিনিসটি আছে তাকেই পেতে সচেষ্ট হয়। তন্ত্র বলছে জীবনের পূর্ণতার উৎস জীবনের মধ্যেই, আধারের মধ্যেই। তান্ত্রিক প্রকৃতির মধ্যে এমন কিছু খুঁজে পেয়েছেন, যেটা হচ্ছে– অদম্য বল, অনন্ত শক্তি, অব্যাহত কর্মপ্রেরণা এবং এর উৎসে রয়েছেন যে চিন্ময়ী মহাশক্তি তান্ত্রিক তাঁকে জেনেছেন। সুতরাং, ওই লীলাময়ী, চৈতন্যময়ী জগন্মাতার হাতে নিজেকে ছেড়ে দিতে তান্ত্রিক একটুও ইতস্তত করেন না। তান্ত্রিক জানেন আধারের প্রাকৃত প্রেরণার মধ্য দিয়ে কর্মবহুল বিক্ষুব্ধ জীবনের ভিতর দিয়ে মহাশক্তি তাকে গড়ে তুলছেন।
তান্ত্রিক তাঁর সাধনায় চিন্ময়ী মহাশক্তিকে সকলের উপরে স্থান দিয়েছেন। তা ছাড়া অন্যান্য সাধনপন্থাগুলির ব্রত হল মুক্তিসাধন, এই যোগে তেমন নয়, এ যে শুধু মুক্তিকেই যোগের উদ্দেশ্য করে তা নয়, এর অন্য উদ্দেশ্য হল পরম চিৎপুরুষের শক্তিকে বিশ্বজনীন ভাবে উপভোগ করা(ভোগ)।

তন্ত্রসাধনা সম্বন্ধে যাঁরা খুব ভালো ভাবে জানেন, তাঁরা বলেন তন্ত্রসাধন ক্রিয়া জ্ঞান, ভক্তি, কর্ম, হঠযোগ ও রাজযোগের অপূর্ব সমন্বয়ে গঠিত। তন্ত্র শাস্ত্রে বিভিন্ন শ্রেণীর সাধকদের জন্য পৃথক পৃথক সাধনার ব্যবস্থা আছে। তান্ত্রিকরা বলেন ৬৪ খানি প্রধান তন্ত্র প্রচলিত আছে। এই শাস্ত্রগুলিতে বিভিন্নপ্রকার ক্রিয়াকাণ্ডের ব্যবস্থা আছে। যাঁরা তামসিক প্রকৃতির তাঁদের ক্রমিক উন্নতির জন্য নির্দিষ্ট তান্ত্রিক বিধানের নাম ‘পশ্বাচার‘।
যাঁরা রাজসিক প্রকৃতির, তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট বিধানের নাম ‘বীরাচার’।
উপরোক্ত দুই শ্রেণীর সাধকেরা তন্ত্র সাধনা করেন বিভিন্ন ধরনের ভোগসামর্থ্য লাভ করার জন্য; ফলস্বরূপ বিভিন্ন ধরনের ঐহিক ও পারত্রিক ভোগসুখের যোগ্যতা অর্জন করেন এই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে পারলে।
আর যাঁরা সাত্ত্বিক প্রকৃতির, তাঁরা ঈশ্বরোপলব্ধি ও পূর্ণতা লাভের জন্য তন্ত্র সাধনা করে থাকেন। এই শ্রেণীর সাধকদের জন্য নির্দিষ্ট তান্ত্রিক বিধানের নাম দিব্যাচার। সব তন্ত্রই ভগবানকে শক্তি রূপে আরাধনা করার নির্দেশ দেয়। দুর্গা, কালী, চন্ডী, তারা, ভুবনেশ্বরী, জগদ্ধাত্রী প্রভৃতি তান্ত্রিকদের উপাস্য।
আর এক দিক দিয়ে সমস্ত তন্ত্রের অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে ঐক্য দেখা যায়। তন্ত্রের কতকগুলি অনুষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী সাধককে নানারকম চিত্তাকর্ষক ইন্দ্রিয়ভোগের সংস্পর্শে আসতে হয়, কখনো কখনো ভীতিপ্রদ পরিবেশের মধ্যে ইষ্টদেবীর আরাধনা করা একটা তান্ত্রিক ক্রিয়া। এই ভাবে সাধনা করার উদ্দেশ্যে মনকে একটা আবেগের মধ্যে ফেলে একমনা হতে সাহায্য করা এবং পরে ইষ্টদেবীর চিন্তায় মনকে স্থির করা। তন্ত্রের এই কৌশল সাধককে সিদ্ধিলাভের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয় খুব দ্রুত গতিতে। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে সাধকের পরিণতি হয় শরীর ও মনের বিকলতায়।
(সপ্তত্রিংশ পর্ব আগামী রবিবার)
লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন- 8584063724
৩৫ তম পর্বটি পড়তে ক্লিক করুন– https://agamikalarab.wordpress.com/2020/08/11/what-is-bhakti-yoga/
One thought on “ধারাবাহিক রচনা: আমাদের শ্রী অরবিন্দ(পর্ব-৩৬)”