অসম্পূর্ণ প্রেম(অলৌকিক গল্প)

প্রসেনজিৎ মজুমদার, আগামী কলরব: হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। আলো জ্বালিয়ে দেখলাম ঘড়িতে পৌনে তিনটে। কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকলাম, কিন্তুু চোখে ঘুম আসলো না।
গত দুদিন ধরে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। কারণ কী, বুঝতে পারছি না। হয়তো অতিরিক্ত কাজের চাপে চোখে ঘুম নেই। চাঁদের অল্প আলো বারান্দায় এসে পড়েছে দেখে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম। অল্প আলোতে বারান্দায় এমাথা ওমাথা পায়চারি করছি, এমন সময় আমার দৃষ্টি গেল বাইরে দরজার কাছে । মনে হল কে যেন ওখানে দাঁড়িয়ে আছে! আমি কোনও সাড়া শব্দ না করে দূর দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করলাম ওই ছায়ামূর্তিটা কী করে। কিন্তু তাকে নড়তে চড়তে না দেখে আমার মনটা অতিষ্ঠ হয়ে উঠল।
দক্ষিণ দিক দিয়ে ঝড়ো বাতাসে গাছের ডালগুলো মর মর শব্দে দুলছে । আমি আর এক মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা না করে জিজ্ঞেস করলাম,’কে ওখানে?’ কোনও উত্তর নেই। দ্বিতীয়বার আবার জিজ্ঞেস করলাম। এবারও নিশ্চুপ। বাধ্য হয়ে এগিয়ে গেলাম ওই ছায়ামূর্তির দিকে। একটু সামনে এগোতেই দেখি এলো চুলে একটি মেয়ে হাতে কিছু একটা নিয়ে দাঁড়িয়ে। আরেকটু সামনে এগোতেই আশ্চর্য হলাম! চাঁদের আলোয় তার মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠলো ।
এ সেই সুন্দরী মেয়েটি, যার সঙ্গে আমার তিন বছর আগে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে ।

একসঙ্গে কলেজে পড়তাম আমি আর চন্দ্রিমা। সে অপূর্ব সুন্দরী ,তাকে আমি ভালোবেসে ছিলাম। তবে আমার ভালোবাসার কথা তাকে কোনওদিন বলতে পারিনি। তাকে যে আমার ভালো লাগতো সে কথা আমার অনেক বন্ধু জানত। এমনকি চন্দ্রিমার যে বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল সেও। কিন্তুু চন্দ্রিমা বহুদিন আগে থেকেই অন্য একটা ছেলেকে ভালোবাসতো । এই কথা জানা সত্ত্বেও কি করে তাকে বলতাম আমার ভালোবাসার কথা। কলেজের পড়া শেষ না করে সে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল এমনটাই শুনেছিলাম।
আজ এতদিন পর সে এখানে কী করতে আসবে? আমার ঠিকানাই বা পেল কোথা থেকে! এ কি সত্যিই চন্দ্রিমা না অন্য কেউ। একটু একটু করে তার সামনে এগিয়ে এলাম। বুকের ভিতরটা কেমন হচ্ছিল। যদি সে সত্যিই চন্দ্রিমা না হয়! যদি চন্দ্রিমাই হবে তবে এত রাতে হাতে ট্রলি ব্যাগ নিয়ে এখানে কি করতে আসবে? মনের মধ্যে নানা ভাবনা আসতে থাকে।
চন্দ্রিমাকে দেখে সত্যিই অবাক হলাম। তাকে কলেজে যেমন সুন্দরী দেখেছিলাম এখনো ঠিক তেমনিই সুন্দরী আছে। তার মুখের সৌন্দর্যে একটুও বদল হয়নি। আমি তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। চন্দ্রিমা বলল,’শুধু মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবি! ভিতরে যেতে বলবি না? না কি এখনো চিনতে অসুবিধা হচ্ছে?’ আমি কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ চল।’ দুজনে ঘরের ভিতরে চলে আসি। চন্দ্রিমা চেয়ারে বসলো। আমি তার মুখের উপর থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না। দুজন দুজনের চোখে চোখ পড়তে চন্দ্রিমা বলল ‘তোর কি এখনো সংকোচ বোধ হচ্ছে, আমি চন্দ্রিমা কি না।’ আমি বোকার মতো বলে উঠলাম,’হ্যাঁ, মানে, না না! আসলে তা নয়। অনেক দিন পর তোকে দেখছি তাই। তা এখন কোথা থেকে এলি?’ –‘বলবো, বলবো, সব বলব। এখন একটু বিশ্রাম নিতে দে।’ সে কিছু খাবে কি না জিজ্ঞেস করলাম। ‘না’ উত্তর দিল। কিছুক্ষণ পর সে বলতে শুরু করল, ‘আমি জানতাম তুই আমাকে ভালবাসতিস। কিন্তু সে কথা তুই আমাকে বলিস নি । রঞ্জনের সাথে আমার সম্পর্ক অনেক দিনের। আমি তাকে ভালবাসতাম, কিন্তুু সে আমাকে কোনদিনও ভালোবাসেনি। শুধু ভালোবেসেছে আমার বাবার সম্পত্তিকে। আর যখন সে কথা বুঝলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ওকে আমি চিনতে পারিনি, রঞ্জন অত্যন্ত খারাপ ছেলে। আমাদের বিয়ের পর তার সাথে আমার কোনদিনই বনিবনা হয়নি। সে আমার জীবনকে নষ্ট করে দিয়েছে। আমি শেষ হয়ে গেছি। ও আমাকে দিনের পর দিন অত্যাচার করে আমার জীবনটাকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। বাধ্য করেছে নিজেকে শেষ করে দিতে।’
এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে খানিকক্ষণের জন্য নীরব রইল চন্দ্রিমা। তারপর বলতে শুরু করল,’আজই আমি ঘর ছেড়েছি তোর আশ্রয়ে থাকবো বলে। আর তোর সমস্ত খবরই আমার জানা। কথা শেষ করে সে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। আমি তার কষ্ট আর দেখতে পারছিলাম না। তাকে টেনে নিলাম নিজের বুকে।
–‘সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কোনও চিন্তা করিস না।’ তাকে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না। চন্দ্রিমা কাঁদতে কাঁদতে বলল,’আর কিছু ঠিক হবে না। অনেক দেরি হয়ে গেছে। তুই আমাকে এত ভালবাসিস যদি একবার যদি মুখ ফুটে বলতে পারতিস তাহলে হয়তো আজকে এ পরিস্থিতি কখনই আসতো না। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল চন্দ্রিমা।
যা হয়ে গেছে তাই নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই। চন্দ্রিমাকে আমার বিছানায় ঘুমাতে বললাম। সে বললো,’আর কিছুক্ষণ পর ভোর হয়ে যাবে, আর ঘুমাবো না।’ আমিও ঘুমাতে পারলাম না। ঘরে আসা অতিথি জেগে বসে থাকবে আর আমি কীভাবে ঘুমাব।
চেয়ারে বসে চন্দ্রিমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভোরের দিকে চোখটা লেগে গেছিল। সকালবেলা যখন চোখ খুললাম, দেখি ঘরে চন্দ্রিমা নেই, তার ব্যাগটাও উধাও। সমস্ত ঘরে তাকে খুজলাম। কোথাও পেলাম না। মুহূর্তের মধ্যে যেন সবকিছু বাতাসের সাথে মিশে গেছে।

সমস্ত কথা মন থেকে মুছে ফেলে চেষ্টা করছি, এমন সময় খবরের কাগজ এল বাড়িতে। খবরের কাগজের তৃতীয় পাতা পড়তে গিয়ে অবাক হলাম। জায়গার নাম দিয়ে লেখা ঘরের গৃহবধূ বয়স চব্বিশ বছর, নাম চন্দ্রিমা রায়, সঙ্গে বিয়ের একটা ছবিও দেওয়া। গলায় দড়ি দেওয়া অবস্থায় ঝুলতে দেখা যায় তার ঘরে । পুলিশ দেহ উদ্ধার করে নিয়ে গেছে। তাদের সন্দেহ স্বামী রঞ্জন রায়কে। সে ফেরার।

খবরটা পড়ে আমার গলাটা শুকিয়ে সমস্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলাম।

Leave a comment