কলকাতার গুপ্ত কথা(ধারাবাহিক)

কবিতীর্থ

প্রিয়াঙ্কা সিংহ: মূলত মধুসূদন, রঙ্গলাল ও হেমচন্দ্র এই তিন কবির স্মৃতি বিজড়িত খিদিরপুর কালক্রমে কবিতীর্থ নামে আদৃত হচ্ছে।

মধুসূদনের পিতা মুন্সি রাজনারায়ণ দত্ত অধিকতর উন্নতি ও অর্থ উপার্জনের আশায় যশোহর ত্যাগ করে কলকাতায় এসে অতি অল্প সময়ের মধ্যে প্রভূত উন্নতি করেন। ক্রমশ খিদিরপুর বড় রাস্তার ওপর একটা প্রকাণ্ড বাড়ি কিনে ফেলেন। হিন্দু কলেজের মেধাবী ছাত্র এবং ইংরেজি ভাষায় প্রথম বাঙালি কবি কাশীপ্রসাদ ঘোষের মাতামহ ছিলেন এই বাড়ির মালিক। এখন যেখানে খিদিরপুর প্রেস ২০ বি কার্ল মার্ক্স সরণি সেটাই ছিল মধুসূদনের পৈতৃক বাড়ি। ১৮৩১ সালেই মধুসূদন যশোহরের সাগরদাঁড়ী থেকে মা বাবার হাত ধরে আসেন এই বাড়িতে।
খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণের পর মাদ্রাজ থেকে ফিরে তিনি জেমস লেনে এক ভাড়া বাড়িতে ওঠেন, পরে হাউস রোডের বাড়িতে থাকতে শুরু করেন।

রাজনারায়ণের বাড়ির আশেপাশে কিছু বাড়ি ছিল। একটার মালিক ছিলেন রামকমল মুখোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তার অভাব পূরণ করেন ভাগনেরা। মধু তাদের সাথী হন। এঁদের অন্যতম ছিলেন রঙ্গলাল। এছাড়া গৌরদাস বসাক , ভূদেব মুখোপাধ্যায় ও রাজনারায়ণ বসুও ছিলেন তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু।

রঙ্গলালের জন্ম হুগলির বাঁকুলিয়া গ্রামে। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি পিতাকে হারান। মাতৃবিয়োগের পর তিনি মামার বাড়িতে বড় হন। জ্যেষ্ঠ মাতুল রামকমল ছিলেন খিদিরপুরের আদিবাসী। রঙ্গলাল তাঁর কাছেই থাকতেন। সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতা ছিল গভীর। ছাতুবাবু-লাটুবাবুদের কবির দলে তিনি ছিলেন কবি। সহ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন ‘এডুকেশন গেজেট’ এর। পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনের জন্য তিনি দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেছেন বরাবর।

রঙ্গলালের বাড়ি

কবিতীর্থর ত্রয়ী কবির অন্যতম হলেন হেমচন্দ্র। তিনি ছিলেন স্বভাব কবি। হুগলির গুলিটা গ্রাম থেকে খিদিরপুর আসেন নয় বছর বয়সে। ওকালতিতে তিনি প্রভূত অর্থ উপার্জন করেন। হেমচন্দ্র তাঁর লেখনীর মাধ্যমে একদিকে যেমন বাংলার সাহিত্যকে করেছেন সমৃদ্ধ, অপরদিকে তেমনি দেশাত্মবোধে সম্পৃক্ত করেছেন দেশবাসীকে। তাঁর স্বদেশ ভাবনার গান গুলো সে সময় বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে।এডুকেশন গেজেটে তাঁর “ভারত সংগীত” প্রকাশিত হলে তিনি সরকারের কোপানলে পড়েন। তাঁর রচিত ‘কুলীন মহিলা বিলাপ’ কবিতা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বহু বিবাহ রোধে আন্দোলনের সহায়ক হয়।

মধুসুদন, রঙ্গলাল ও হেমচন্দ্র এই তিন বরেণ্য কবির শেষ জীবন যেন একই ভাগ্যসূত্রে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। তিন জনই জীবনের অন্তিম দিনগুলি নিদারুন শারীরিক কষ্টে পড়েন। এই তিন মহাকবির স্মৃতি ধন্য খিদিরপুরই আজ ‘কবিতীর্থ‘।

মধুসূদনের স্মৃতিতে এখানে রয়েছে মধুসুদন সরণি(মাইকেল দত্ত স্ট্রিট)। আর গড়ে উঠেছে ঐতিহ্যশালী গ্রন্থাগার– মাইকেল মধুসূদন লাইব্রেরী। হেমচন্দ্র স্ট্রিট ও হেমচন্দ্র পাঠাগার কবি হেমচন্দ্রের স্মৃতি বহন করছে। অন্যদিকে রঙ্গলাল-স্মৃতিলাঞ্ছিত পথ রঙ্গলাল স্ট্রিট। তাঁর নামে যে রঙ্গলাল পাঠাগার গড়ে ওঠে, বর্তমানে যেটি অবলুপ্ত।

কবিতীর্থের অহঙ্কার বৃদ্ধিতে আরো অনেকের অবদান আছে। কবি অক্ষয় কুমার দত্ত(তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক), জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মহিলাকবি মোক্ষদায়িনী মুখোপাধ্যায়(বঙ্গ মহিলা পত্রিকার সম্পাদিকা), কবি ঈশানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়(হেমচন্দ্রের অনুজ), কবি গণেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়(রঙ্গলালের অগ্রজ), কবি কালীপ্রসাদ ঘোষ, লেখক ও ঐতিহাসিক হরিসাধন মুখোপাধ্যয়, কবি দুর্গাদাস সরকার প্রমুখ এখানকার বাসিন্দা ছিলেন।

(লেখিকার সঙ্গে যোগাযোগ করুন- priyanka.singha1811@gmail.com)

‘কলকাতার গুপ্তকথা’র আগের পর্বটি পড়তে ক্লিক করুন- https://agamikalarab.com/2019/11/30/

2 thoughts on “কলকাতার গুপ্ত কথা(ধারাবাহিক)

Leave a comment