ভাষা দিবসঃ বাংলা ভাষা কি আজ অবক্ষয়ের পথে?

চিত্র সৌজন্য: ইউ টিউব

গৌতম গুহ, আগামী কলরব: ভাষা মানে শুধু কিছু শব্দের যোগফল নয়। ভাষা একটা স্বতন্ত্র এবং নির্দিষ্ট সংস্কৃতির প্রকাশ। সংস্কৃতি পাল্টে গেলে ভাষাও রূপ পাল্টায়, ভাষার পরিচয় পাল্টায়। ১৪০০ বছরের কিছু আগে আরব দেশটা ছিল বহুত্ববাদী। হিন্দু সংস্কৃতির অনুরূপ ছিল সেই সংস্কৃতি। কাবা-র মন্দিরে ছিল প্রায় ৩৬০ জন দেব-দেবীর মূর্তি। ছিলেন দেবী লাত-মানত-উজ্জা, সসম্ভ্রমে পূজা পেতেন হুবাল দেব। তখন আরবের ভাষা শুনে কেউই সেটাকে “ইসলামী ভাষা” বলে মনে করত না। কারণ ইসলাম ধর্মের তখনো জন্মই হয়নি। তাই আরবী ভাষার পরিচয় সেই যুগে ছিল “মূর্তি পূজারী জাতির ভাষা”। আর আজ? ইসলামের প্রভাবে দেশটার পরিচয় এখন এতটাই বদলে গেছে যে এখন কারও মুখে আরবী ভাষা শুনলেই তাকে আমরা মুসলমান বলে ধরে নিই। ভাষা কিন্তু বদলায়নি, আগেও “আরবী ভাষা” ছিল, এখনো “আরবী ভাষা”ই আছে। শুধু ওদের ধর্মটা বদলেছে আর তাতেই পাল্টে গেছে ভাষার চরিত্র এবং পরিচয়। হুবহু একই ব্যাপার ঘটেছে মিশরে। মিশর হল অত্যন্ত প্রাচীন সভ্যতার জন্মভূমি। এই দেশটাও একসময় ছিল বহু ঈশ্বর-এর দেশ। নানান দেবদেবীর মূর্তি পূজাই ছিল এই দেশের প্রধান ধর্ম। তখনই সাহিত্য, স্থাপত্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতির চূড়ায় উঠেছিল সে দেশ। তারপর মিশরকে ছারখার করতে ধেয়ে এল সভ্যতার অন্যতম পাপ, আরব সাম্রাজ্যবাদ। দখল হয়ে গেল মিশর। আরব সাম্রাজ্যবাদীরা প্রথমেই চাপিয়ে দিল ইসলাম ধর্ম। তারপর বদলে দিল দেশের নাম। মিশরের আদি নাম ছিল “হুট কপ্টা”, সেই নাম পাল্টে আরবী ভাষায় নতুন নাম রাখা হল “মিশর”! এই আরবী নাম আজকে এত পরিচিতি পেয়েছে যে বাংলাতেও আমরা একে “মিশর” বলেই চিনি। মাটির নাম পাল্টে যাওয়া মানেই জাতীয় পরিচয় হাতছাড়া হওয়া। ফলে বাইরে থেকে মিশরে আসা আরবীয়রা হয়ে গেল “মিশরীয়” আর প্রাচীন মিশরীয়রা হয়ে গেল “কপ্ট”! যে মিশরের আদি নাম ছিল “হুট কপ্টা”, নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে সেই দেশের আসল উত্তরাধিকারী হল এই কপ্ট-রা। অথচ দেশের নাম পাল্টে মিশর রাখার ফলে মিশর কথাটার সাথে কপ্ট কথাটার আর কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। মনে হবে “মিশর” আর “কপ্ট” কথা দুটো এতটাই আলাদা, যেন এই দুটোর একে অপরের সাথে কোনও সম্পর্কই নেই। বহিরাগত আরবরা এর পরে পরেই মিশরের আদি কপ্টিক ভাষার লিপি পাল্টে দিল, চাপিয়ে দিল আরবী লিপি। ধীরে ধীরে কপ্টিক ভাষাটাকেই সরিয়ে দিয়ে গোটা দেশে প্রতিষ্ঠিত হল আরবী ভাষা। আজও মিশরের রাষ্ট্রভাষা আরবী, ওদের জাতীয় সংগীত আরবীতে লেখা, জাতীয় লিপি আরবী। “হুট কপ্টা” যেদিন থেকে আরবী নাম “মিশর” হল, সেদিন থেকেই কপ্ট ভাষা এবং জাতির দুর্ভাগ্যের সূচনা। আজ কপ্ট জাতি নিজেদের দেশ “হুট কপ্টা”-তে অত্যাচারিত, অবহেলিত। গোটা বিশ্ব সেই কান্না শুনছে না, বুঝছে না। বুঝবেই বা কী করে! দেশের নাম পাল্টে মিশর হবার পর, পৃথিবীর কেউ বুঝতেই তো পারছে না কপ্টরাই মিশর-এর আসল উত্তরাধিকারী। এইখানেই দেশ এবং জাতি রক্ষায় ভাষার গুরুত্ব।

ঠিক এই একই চাল চালা হয়েছে কাশ্মীরে। কাশ্মীর ঋষি কশ্যপ-এর দেশ, কাশ্মিরী বলতে আদিতে হিন্দুই বোঝাত। সেখানে যখন আরবী হানাদারেরা এল এবং ইসলাম চাপিয়ে দিল, ধীরে ধীরে কাশ্মীরের জনবিন্যাস বদলাতে শুরু করল। বদলাতে বদলাতে আজ এমন অবস্থা হয়েছে, “কাশ্মিরী” বলতেই এখন মুসলমান বোঝায়। “কাশ্মিরী শালওয়ালা” শুনলেই আমরা ফর্সা চেহারার এক মুসলমান পুরুষকে কল্পনা করে নিই। আদি কাশ্মিরী অর্থাৎ কাশ্মিরী হিন্দুদেরকেই এখন নিজেদের আলাদা দেখাতে “কাশ্মিরী পন্ডিত” লিখতে হয়। অর্থাৎ আজকাল “কাশ্মিরী” মানে শুধুমাত্র কাশ্মীরের মুসলমান; আর আদি কাশ্মীরীদের লিখতে হয় “কাশ্মিরী পন্ডিত”। অথচ এটা ঠিক উল্টোটাই হবার কথা ছিল। যারা আগে থেকেই কাশ্মীরে ছিলেন, তারা নিজেদের জাতি পরিচয়টার অবধি অধিকার খুইয়েছেন আর যারা পরে এল এবং বহিরাগত-দের সংমিশ্রনে সৃষ্টি হল, তারা “কাশ্মিরী” জাতিপরিচয়টা পুরোপুরি দখল করে বসেছে। শুধু তাইই নয়, কাশ্মিরী ভাষা লেখার নিজস্ব লিপি ছিল, যার নাম শারদা লিপি। সেই লিপি তুলে দিয়ে কাশ্মীরের মুসলিমরা কাশ্মিরী লেখেন আরবী বর্ণমালায়। এমন কি ৩৭০ ধারা ওঠার আগে পর্যন্ত জম্মু কাশ্মীরের রাজ্য ভাষা ছিল আরবী লিপিতে লিখিত ঊর্দু। তবুও শেখ আব্দুল্লা, মুফতি মোহাম্মদ সৈয়দরাই নাকি আসল “কাশ্মিরী”, যাদের নামে একটাও কাশ্মিরী শব্দ নেই! আর টিকা লাল টাপলু, গিরিজা টিকু ইত্যাদিরা শুধুই “কাশ্মিরী পন্ডিত”! অথচ টিকু, টাপলু, গন্জু ইত্যাদি পদবী শুনলেই বোঝা যায় যে এগুলো কাশ্মীরের পদবী; শেখ-সৈয়দ পদবী কাশ্মীরের মুসলমানের নাকি পারস্যের মুসলমানের, এটা বোঝার কোনও রাস্তা নেই। বিজাতীয়রা যখন ভাষার দখল নেয়, জাতি-পরিচয়টাকেও এভাবেই কেড়ে নেয়। বাংলা ভাষা রক্ষার দরকারটা ঠিক এই রকম ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আটকাতে।

প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ আবার বাংলা ভাষার শব্দ ভান্ডার নিয়ে অমূলক পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলা ভাষার যথেচ্ছ আরবীকরণ করা হয়েছে। দিদি-কে আপা, মাসিকে খালা, পিসিকে ফুফা, মাংসকে গোশত, স্বর্গকে বেহেশত… এই তালিকা শেষ হবার নয়। বাংলা ভাষায় প্রায় ২৫-৩০% আরবী শব্দ যোগ করেছে বাংলাদেশ। বাংলা ভাষায় শব্দ থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে সেগুলোর আরবী প্রতিশব্দ দেওয়া হয়েছে, এবং এতখানি ভাষা বিকৃতি ঘটানোর পরেও পশ্চিমবঙ্গের বহু বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশকেই “বাংলা ভাষার ধারক ও বাহক” বা “প্রকৃত বাঙালি” ইত্যাদি বিশেষণে অভিহিত করে ধন্য ধন্য করছেন!

বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদের লিপি

আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে, যখন চর্যাপদে লেখা হয়- “আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলি”, অর্থাৎ “আজ থেকে ভুসুকু বাঙালি হয়ে গেল”, তখন বাংলায় মুসলমান কোথায় ছিল? মহাভারতে যে বঙ্গ রাজ্যের উল্লেখ রয়েছে, প্রাচীন চৈনিক সাহিত্যে বঙ্গ রাজ্যের অধিবাসীদের “বং” বলা হয়েছে, কখনো লেখা হয়েছে “বং লি”! এতেও কি বোঝা যাচ্ছে না যে ইসলাম আসার বহু আগে থেকেই “বাঙালি” নামক একটা জাতির অস্তিত্ব ছিল। তাহলে বাংলাভাষী মুসলিমরাই কীভাবে “প্রকৃত বাঙালি” হন? শব্দ ভান্ডারে প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও ভাষার মধ্যে গাদা গাদা আরবী শব্দ প্রবেশ করিয়ে ভাষাটার চরিত্রই পাল্টে দেওয়া কি কোনো অবদানের মধ্যে পড়ে! কেউ বাংলা ভাষাপ্রেমী হলে আরবী শব্দ ঢোকানোর জন্য এত আকুলতা কেন? ইতালীয় বা ফরাসী শব্দ কেন নয়? তাছাড়া একটা ভাষাতে অন্য ভাষার এত শব্দ ঢোকাতে হবেই বা কেন? বাংলাতে “মাংস” নামক শব্দটা থাকতেও যখন কেউ “গোশত” বলে, “নরক” থাকতেও “জাহান্নাম” বলে; তখন এই ধরণের আচরণ তাদের বাংলাপ্রেম নির্দেশ করে না, আরবী প্রেমই নির্দেশ করে। এইরকম ভাষাপ্রেম কি আসলে ভাষা-দখল এবং জাতি-দখলের অপচেষ্টা নয়!

ভাষা দখলের সাথে জাতি দখলের সুস্পষ্ট সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্কটা বাঙালিকে খুব পরিষ্কার ভাবে বুঝতে হবে। প্রথম ধাপে বাংলার মধ্যে গুচ্ছ আরবী ঢুকিয়ে ওদের বাংলা আর আমাদের বাংলা-কে আলাদা করা হবে। এতে এক ঢিলে দুটো পাখি মারা যায়। প্রথমতঃ ওরা আর আমরায় ভাগ তৈরি হল, আর দ্বিতীয়তঃ ওদের হাতেও বাংলা ভাষার অর্ধেক অধিকার চলে যাওয়া। আরবী মেশানো বাংলাটা যখন ওদের বাংলা, তখন সেই বাংলাটাকে নিয়ে ওরা ইচ্ছেমত কাটাছেঁড়া করতেই পারে।
এবার দ্বিতীয় ধাপে শুরু হয়েছে ভাষার উপর ভিত্তি করে জাতি পরিচয় গুলিয়ে দেবার চেষ্টা। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ক্ষমতায় ভর দিয়ে চেষ্টা হচ্ছে “বাঙালি” পরিচয়টাই কেড়ে নেবার। যারা বহিরাগত বখতিয়ার খলজি, শাহ জালাল, হুসেন শা, সিরাজদ্দৌলাকে নিয়ে গর্ববোধ করে, তারাই নাকি বাঙালি! আর যারা এই বহিরাগতদের খলনায়ক বলে, তারা হয়ে গেল গোঁড়া সাম্প্রদায়িক। জাতি দখল আসলে মাটি দখলের পূর্বসূরী। জাতি পরিচয় দখল হয়ে গেলে মাটি দখলটা অনেক সোজা হয়ে যায়। ভেবে দেখুন তো, বর্তমান বাংলাদেশে কী হচ্ছে। ওখানে মুসলিমরা হয়ে গেছে “বাঙালি”, আর যারা সত্যিকারের বাঙালি, তারা হয়ে গেছে “হিন্দু”! অর্থাৎ “বাংলাদেশে বাঙালিরা সংখ্যাগুরু আর হিন্দুরা সংখ্যালঘু”! কথাটার তাৎপর্য বুঝতে পারছেন? বাংলাদেশ আর বাঙালি, এই কথা দুটোয় অনেক মিল আছে। কিন্তু বাংলাদেশ এর হিন্দু, এই শব্দ দুটোয় কোনও মিল নেই। অতএব, “বাঙালি” জাতিপরিচয়টা যদি মুসলিমরা পুরোপুরি দখল করে নেন, পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের মেরে তাড়িয়ে দিলেও গোটা পৃথিবীর কোনও সহানুভূতিই আমরা পাব না। গোটা পৃথিবী ভাববে “বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গ তো বাঙালিদেরই। তাহলে এই হিন্দু নামক লোকগুলোই নিশ্চয় বহিরাগত। বাঙালিরা হিন্দুদের মেরে তাড়ানোটা তার মানে ভুমিপুত্রের অধিকার প্রতিষ্ঠা।”
ঠিক এই ব্যাপারটাই কাশ্মীরে ঘটেছিল। “কাশ্মিরী” মানেই যেহেতু হয়ে গেছিল মুসলিম, সারা বিশ্ব ধরেই নিয়েছিল “কাশ্মীর তো কাশ্মিরী থুড়ি মুস্লিমদেরই অধিকার”! এই জট এখনো খোলা যায়নি।
বাঙালি পরিচয়টা নিয়েও এই একই জট পাকানোর চেষ্টা চলছে। এর অন্যতম অস্ত্র হল “একুশে ফেব্রুয়ারি”!
“বাঙালি” শুনলে গোটা পৃথিবী যেন ভাবে জোব্বা পরা গোঁফহীন কোনও দাঁড়িয়াল চাচাকে। সেজন্যই আজকের দিনটা পালন করা এত জরুরী। না, “ভাষা দিবস” হিসেবে নয়, “আরব সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দিবস” হিসেবে।
ঠুকে বলো বুকের ছাতি,
সবার উপর ধর্ম-জাতি।
আমার ভাষা, আমার মা,
আরবীকরণ মানব না।

মহাভারতের কাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত বাঙালি জাতি একটাই। চৈনিক পুঁথি থেকে চর্যাপদ হয়ে শ্রীলঙ্কার মহাবংশম পর্যন্ত সাক্ষ্য দিচ্ছে বাঙালি বলতে আসলে কারা। যেভাবে বাংলা ভাব-বচনের মধ্যে ঊর্দু বা ফার্সি অপভ্রংশ অনুপ্রবেশ করেছে তাতে বাংলা ভাষার ভাবমূর্তি কতটুকু মহিমান্বিত হয়েছে তা আজ ভেবে দেখার সময় এসেছে। সব শেষে বলতে হয় ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সমান’, তাই আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই।

Leave a comment